
ছবি: সংগৃহীত
ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও বিতর্ক যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালের। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া, বিশ্বকাপ দল নির্বাচন ঘিরে নাটকীয়তা, আকস্মিক অবসর এবং পরে তা প্রত্যাহার—এইসব মিলিয়ে গত এক বছরে তামিম ছিলেন দেশের ক্রিকেট অঙ্গনের অন্যতম আলোচিত ও বিতর্কিত চরিত্র। তবে এবার যে ভাষায় তিনি নিজের অবস্থান জানালেন, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘদিনের চাপ, গুঞ্জন ও ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতি’র বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ এখন সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছেছে।
তামিম ইকবাল গতকাল শুক্রবার (৭ জুন) রাতে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি সুদৃঢ়, ব্যতিক্রমী ও রীতিমতো বিস্ফোরক বার্তা দিয়ে আবারও খবরের শিরোনামে এসেছেন। কোনো ব্যক্তির নাম বা গোষ্ঠীর পরিচয় স্পষ্ট করে না বললেও, তার কথার সারবস্তু থেকে ইঙ্গিত মিলেছে—বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে লক্ষ্য করেই এই বক্তব্য।
তিনি লেখেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে কখনো হাত মেলাব না! যারা আমার পিছু নিয়েছেন, আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছেন আমাকে হাত করার জন্য, সেই মানুষগুলোকে বলছি—আমি কখনও আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না।”
এই এক বাক্যের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে গভীর ক্ষোভ, দীর্ঘদিনের অভিমান, এবং বহুচর্চিত অন্ধকার অধ্যায়ের প্রতি একরাশ জবাব। যদিও তিনি কারও নাম বলেননি, তবে বোঝা যাচ্ছে, তামিম একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে এই বার্তা দিয়েছেন—যারা, তার দাবি অনুযায়ী, ‘তাকে ছোট করতে’, ‘প্রতিপন্ন করতে’ এবং ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে’ সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, তামিমের এই স্ট্যাটাসের সময়কাল, বক্তব্যের ভাষা এবং প্রেক্ষাপট দেখে মনে হচ্ছে, সম্প্রতি ২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবির পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়েই এই পোস্ট। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, সেই কমিটির কিছু তথ্য সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এতে বোর্ডের কিছু সিদ্ধান্ত, খেলোয়াড়দের ভূমিকা এবং পরোক্ষভাবে তামিম ইকবালের নাম জড়িয়ে কিছু মন্তব্য উঠে এসেছে।
তামিম স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই প্রতিবেদন বা সংশ্লিষ্ট মন্তব্য নিয়ে তিনি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তার ভাষায়, “কোনো একজন ব্যক্তির নিজস্ব ধারণা আর তদন্তে রিপোর্টে অভিযুক্ত হওয়া—এই দুটির মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল।”
তিনি আরও বলেন, “আমি তো তখন দলেই ছিলাম না! তাহলে তদন্ত কমিটি কেন আমাকে সেই বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করল না? যদি আমার কোনো ভূমিকা থাকত, নিশ্চয়ই একবার হলেও সেই প্রসঙ্গ আসত। অথচ এখন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে, যেন আমি কোনো অপরাধ করেছি।”
এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, তামিম মনে করছেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্টের বাইরে আলাদাভাবে তার বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে, এবং এতে নিরপেক্ষতার অভাব রয়েছে।
তামিম আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, যা তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনারও ইঙ্গিতবাহী। অনেক সময়ই জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটারদের বিসিবিতে বিভিন্ন পদে যুক্ত হতে দেখা যায়। এমনকি তামিমের ক্ষেত্রেও আলোচনা ছিল, তিনি ভবিষ্যতে ক্রিকেট প্রশাসনে আসবেন কি না।
এই পোস্টে তামিম সে প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট বার্তা দিয়েছেন: “যদি কখনো ক্রিকেট প্রশাসনে আসি, সঠিক পথ ধরেই আসব এবং শুধুমাত্র ক্রিকেটের ভালোর জন্য আসব। প্রয়োজন হলে কখনো ক্রিকেট বোর্ডে আসব না, তবুও আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না।”
এখানে ‘আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না’ বক্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তামিম যেন বোর্ডের একটি নির্দিষ্ট অংশ, বা কোনো গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিদের ইঙ্গিত করছেন—যাদের কাজকর্ম বা নীতিগত অবস্থান তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
পোস্টটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো—তামিম বারবার একথা বলছেন, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে কিছু করতে চান না। বরং, সব সময়ই দেশের ক্রিকেটকে সামনে রেখে কাজ করতে চান। এই বক্তব্য তার অতীত ক্যারিয়ার, জাতীয় দলের জন্য অবদান এবং নেতৃত্ব দেওয়ার সময়কার আচরণ ও মনোভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তিনি শেষদিকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এই ব্যাপারটিকে যারা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করছেন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, তাদেরকে আবারো বলছি, আমাকে কোনোভাবেই আপনাদের কাতারে পাবেন না। আমি হাত মেলাব না।”
এই হুঁশিয়ারি যেন বোর্ডের অভ্যন্তরে বিদ্যমান ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে এক অনড় অবস্থান।
তামিমের এই পোস্টের পর অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে—‘আপনাদের সঙ্গে হাত মেলাব না’—এই কথার পেছনে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন?
এখনো স্পষ্টভাবে কোনো নাম বলেননি তামিম। তবে ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে দুটি সম্ভাবনা কাজ করছে—
বোর্ডের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, যারা গত এক বছর ধরে তামিমের বিপক্ষে নানা বক্তব্য দিয়েছেন বা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তদন্ত কমিটির সঙ্গে যুক্ত কিছু ব্যক্তি বা বোর্ড ঘনিষ্ঠ সংবাদকর্মী, যারা তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার চালিয়ে তামিমের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছেন।
তবে এই ‘আপনারা’ শব্দটি দিয়েই তামিম যেন বোর্ডের অপ্রকাশ্য এক ‘চক্র’কে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন, যারা ক্রিকেটারদের সিদ্ধান্ত, ভাবমূর্তি ও ক্যারিয়ারে প্রভাব বিস্তার করতে চায়।
তামিমের এই পোস্ট প্রকাশের পরপরই তা ভাইরাল হয়ে যায়। ভক্ত-অনুরাগী থেকে শুরু করে ক্রীড়া সাংবাদিক, সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষকরা বিষয়টি নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
অনেকে তামিমের স্পষ্ট বক্তব্যকে ‘সাহসী’ বলছেন। তাদের মতে, দেশের ক্রিকেটে যেভাবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দলাদলি বেড়েছে, সেখানে তামিমের মতো একজন সিনিয়র ক্রিকেটারের এমন অবস্থান নেওয়া সময়োপযোগী।
তবে কেউ কেউ মনে করছেন, এই ধরনের প্রকাশ্য পোস্টের বদলে তামিম ইকবাল যদি বিষয়টি বোর্ডের ভেতরে আলাপ করতেন বা মিডিয়াতে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে বলতেন, তাহলে সেটা আরও গঠনমূলক হতো।
তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ১৫ বছরের বেশি সময় জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করে তিনি হয়ে উঠেছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ের অধিকারী। তবে ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে নানা নাটকীয়তা, মনোমালিন্য ও রাজনীতির শিকার হয়েছেন তিনি—এমনটা মনে করেন অনেকেই।
তার এই সর্বশেষ পোস্টে ফুটে উঠেছে অভিমান, ক্ষোভ এবং নিজেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা করে নেওয়ার চেষ্টা। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তাও দিয়েছেন—ক্রিকেটের কল্যাণে কাজ করতে চাইলে তিনি প্রস্তুত, তবে অন্যায় ও ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে কখনোই একত্র হবেন না।
‘হাত মেলাব না’—শুধু একটি বাক্য নয়, এটি যেন একটি মনোভাব, একটি অবস্থান, আর দীর্ঘদিনের নীরবতার পর উচ্চারিত এক প্রতিরোধের ভাষা। এখন দেখার বিষয়, এই বার্তার প্রতিক্রিয়ায় বিসিবি কিংবা সংশ্লিষ্টরা কী অবস্থান নেয়, এবং তামিম নিজেই সামনে আর কী তথ্য প্রকাশ করেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ