
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যেখানে বিনিয়োগকারীরা মুনাফার আশায় পুঁজিবাজারে প্রবেশ করতেন, এখন সেই আশা একের পর এক হতাশায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, বিনিয়োগকারীরা দিনে দিনে তাদের পুঁজি হারাচ্ছেন, এবং সেই ক্ষতির মাপ দিনের পর দিন বড় হচ্ছে। সরকার পরিবর্তনের পর বাজারে কিছু আশার আলো দেখা গিয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে পুঁজিবাজারের পতন থামছে না। বরং, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে।
বর্তমানে, দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে দরপতন চলমান। এই পতন থামাতে সরকার কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। পুঁজিবাজারের পতন শুধু চলছেই, বরং এটি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দামও অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। এ ঘটনা বাজারে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আস্থার অভাবই পুঁজিবাজারের পতনের মূল কারণ, এবং সেই সঙ্গে রয়েছে ব্যাংক খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে শেয়ার বিক্রি (ফোর্সড সেল), নিয়ন্ত্রক সংস্থায় অস্থিরতা, ইত্যাদি নানা ফ্যাক্টর।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকার পুঁজিবাজারের জন্য কিছু সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছিল, যার কিছু ইতিবাচক প্রভাবও ছিল, যেমন ব্যাংক খাতে উন্নতি, কিন্তু পুঁজিবাজারে তার কোনো প্রভাব এখনও পড়েনি। ফলে, আস্থা ফিরে আসেনি, এবং পুঁজিবাজারে পতন অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি এমন, যে পুঁজিবাজারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, এবং বিনিয়োগকারীরা প্রায় একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
বাজারের বিশ্লেষকরা জানান, গত কয়েক সপ্তাহে পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫০ পয়েন্টেরও বেশি পতন হয়েছে, এবং এই পতন টানা ৯ কর্মদিবস ধরে চলেছে। এর ফলে, ডিএসইএক্স সূচক ৪ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা পুঁজিবাজারের একটি বড় সংকটের সংকেত দেয়। এ ছাড়া, বাজারে লেনদেনও কমে গেছে। সিএসই (চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ)-এও সূচকের পতন হয়েছে, যা বর্তমান পরিস্থিতির আরো অবনতি নির্দেশ করছে।
পুঁজিবাজারের পেশাদার বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ সুদের হারের কারণে বিনিয়োগকারীরা ব্যাংক বা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছেন, যা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, শেয়ারবাজারে মার্জিন ঋণের মাধ্যমে শেয়ার কেনার প্রবণতা কমে যাওয়ার কারণে বাজারে আরো চাপ পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এখনই যদি সুষ্ঠু এবং শক্তিশালী সংস্কার না করা হয়, তবে পুঁজিবাজারের সংকট আরও দীর্ঘ হতে পারে।
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী ক্ষুব্ধ হয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন করে আসছেন। তাদের মতে, বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ছাড়া পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরবে না। তারা দাবি করছেন যে, বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার পদক্ষেপের ফলে বাজারের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে, এবং বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্থের বিশাল অংশ হারাচ্ছেন।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, "দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি বর্তমানে নেতিবাচক, এবং এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারের উন্নতি সম্ভব নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ঋণের হার বৃদ্ধি পুঁজিবাজারের গতিশীলতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।"
পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেছেন, "ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির ফলে, বাজারে চাপ বাড়ছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা পুঁজিবাজারে ছড়িয়ে পড়েছে, এবং এতে বাজারের পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে।"
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, "বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি কমেছে, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ কমে গেছে। এর প্রভাবে পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ সরে যাচ্ছে।"
বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট, অন্যদিকে ব্যাংক খাত এবং অন্যান্য খাতে অবস্থা খারাপ হওয়ায় শেয়ারবাজারে আগ্রহ কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে, শেয়ারবাজার যদি ঘুরে দাঁড়াতে চায়, তবে প্রয়োজন সঠিক সংস্কার এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
এদিকে, বিএসইসির মুখপাত্র মো. আবুল কালাম জানিয়েছেন, "বাজার উন্নয়নের জন্য সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য, পুঁজিবাজারকে সুশৃঙ্খল ও স্থিতিশীলভাবে পরিচালনা করা, এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।"
তবে, বর্তমান পরিস্থিতি যেভাবে চলতে থাকে, তা পুঁজিবাজারের জন্য আশাব্যঞ্জক নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তবে পুঁজিবাজার আরও দীর্ঘ সময় ধরে সংকটের মধ্যে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ