
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিগত দ্বৈরথগুলোর একটি—লিওনেল মেসি বনাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো—ফুটবলপ্রেমীদের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বলে। সময়ের পরিক্রমায় তারা দুই মহাদেশে, দুই ভিন্ন পরিসরে খেলছেন। তবে এখনও তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত কিংবা বক্তব্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। যখন মেসি ও এমবাপ্পের মতো তারকারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে আয়োজিত ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের জন্য, তখন রোনালদো জানিয়ে দিলেন—এই প্রতিযোগিতায় তার কোনও আগ্রহ নেই। বরং তার পূর্ণ মনোযোগ জাতীয় দলের সাফল্যে।
ফিফা ২০২৫ সাল থেকে ক্লাব বিশ্বকাপকে বড় পরিসরে আয়োজনের ঘোষণা দেয়। নতুন ফরম্যাটে মোট ৩২টি দল অংশ নেবে—যার মধ্যে স্থান পাবে বিভিন্ন মহাদেশের চ্যাম্পিয়ন ক্লাবগুলো। এ ধরনের বড় আয়োজন বিশ্বজুড়ে ক্লাব ফুটবলের জনপ্রিয়তাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নেয়া হয়েছে। আয়োজক দেশ যুক্তরাষ্ট্র; যার ফলে মেসির ইন্টার মায়ামি সরাসরি অংশ নিচ্ছে স্বাগতিক ক্লাব হিসেবে। ইউরোপ থেকে খেলবে এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুসের রিয়াল মাদ্রিদ, ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটি, জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখের মতো জায়ান্টরা।
এই মঞ্চে বিশ্বের সেরা তারকাদের একত্রে দেখার সুযোগ থাকলেও, সেখানে থাকছেন না ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
রোনালদোর বর্তমান ক্লাব আল নাসর খেলছে সৌদি প্রো লিগে। এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে শীর্ষ চারে না উঠতে পারায় তারা ক্লাব বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে তাই রোনালদোও থাকছেন না। তবে বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। বিশ্ব ফুটবলে তার জনপ্রিয়তা ও বাজারমূল্য বিবেচনায় রেখে কয়েকটি অংশগ্রহণকারী ক্লাব চাইছিল রোনালদোকে লোনে বা স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে দলে নিতে। তাদের প্রস্তাব রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল ফুটবল মহলে।
তবে রোনালদো সেই সব প্রস্তাব বিবেচনায় নেননি। গতকাল (৭ জুন) এক সাংবাদিক সম্মেলনে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে দেন তিনি।
সাংবাদিকদের সামনে রোনালদো বলেন, “আমি ক্লাব বিশ্বকাপে থাকব না। কিছু ক্লাব যোগাযোগ করেছিল। তাদের কিছু প্রস্তাব যৌক্তিক ছিল, কিছু ছিল না। কিন্তু সবকিছু আপনি করতে পারবেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই টুর্নামেন্টে না যাওয়ার।”
তার এ বক্তব্যে ফুটবলবিশ্ব যেন আবারও বুঝে নেয়—রোনালদোর বয়স বাড়লেও তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণে এখনও তীক্ষ্ণ ও বাস্তববাদী। তিনি যোগ করেন,
“আমি জাতীয় দলের সঙ্গে উয়েফা নেশন্স লিগ ফাইনালের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটিই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। ক্লাব বিশ্বকাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত।”
৩৯ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এখনও পর্তুগাল জাতীয় দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার নেতৃত্বেই ২০১৬ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয় পর্তুগাল। এরপর ২০১৯ সালে প্রথম আসরের নেশন্স লিগ ট্রফিও তার হাত ধরে আসে দেশের ঘরে। এবার তিনি খেলবেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইনালে—নেশন্স লিগের ২০২৫ সালের ফাইনাল ম্যাচে।
আগামীকাল রোববার (৯ জুন) মিউনিখের আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় পর্তুগালের প্রতিপক্ষ হবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী স্পেন। এ ম্যাচকে ঘিরে ইউরোপীয় ফুটবলমহলে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। ম্যাচটি রোনালদোর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ম্যাচটি যদি রোনালদো জিততে পারেন, তাহলে তিনি আবারও প্রমাণ করবেন—জাতীয় দলের জন্য তার নিবেদন এখনও অন্যরকম। এমনকি কিছু বিশ্লেষক বলছেন, ক্লাব ফুটবলে মেসি হয়তো বিশ্বকাপ জিতেছেন, তবে রোনালদো এখন যে বয়সেও জাতীয় দলের হয়ে সম্ভাব্য আরেকটি বড় ট্রফির দ্বারপ্রান্তে—তা এক অনন্য কীর্তি।
তবে কিছু ভক্ত ও বিশ্লেষকের মতে, রোনালদোর ক্লাব বিশ্বকাপে অংশ না নেওয়া তার ব্র্যান্ড ভ্যালু ও জনপ্রিয়তায় সামান্য হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, মার্কিন মুলুকে আয়োজিত এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে প্রচারণা, সম্প্রচার স্বত্ব ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অনেক বেশি। মেসি-এমবাপ্পেরা এই সুযোগ কাজে লাগাবেন, সেখানে রোনালদো অনুপস্থিত থাকলে তার ব্র্যান্ডের তুলনামূলক ক্ষতি হতে পারে—এমন মতও রয়েছে।
তবে রোনালদো বরাবরের মতোই এসব ‘বাণিজ্যিক’ দিককে পিছনে রেখে মাঠের খেলাকেই মুখ্য বলে বিবেচনা করেছেন।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বর্তমানে ফুটবল ইতিহাসের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি যা করেন, তা অনুসরণ করেন লক্ষ-কোটি ভক্ত। ক্লাব বিশ্বকাপের মতো একটি বাণিজ্যিক ও প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে সুযোগ পেয়েও অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত তার আত্মবিশ্বাস ও বাস্তবতা বিচার করে নেয়া এক দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
যেখানে অনেক তারকা ক্যারিয়ারের শেষ দিকে অর্থ, প্রচার ও পুরস্কারের পেছনে ছুটেন, সেখানে রোনালদো যেন নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন সেই ‘জাতীয় গর্ব’ ও দেশের হয়ে খেলাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে ধরে নিয়েই।
এখন তার লক্ষ্য একটাই—নেশন্স লিগের ফাইনাল জয়। ফুটবলবিশ্ব তাকিয়ে আছে সেই রোববারের সন্ধ্যার দিকে, যখন রোনালদো হয়তো আবারও নিজের জাত প্রমাণ করবেন। আর ক্লাব বিশ্বকাপ? সেটি আপাতত তার সময়সূচিতে নেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ