
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা—বাংলাদেশের রাজধানী, কর্মব্যস্ততার প্রতিচ্ছবি, এক অনির্বচনীয় গতিময় শহর। যেখানে প্রতিটি সকাল শুরু হয় যানজটে, কাঁচাবাজারের কোলাহলে, অফিসগামী মানুষের ব্যস্ত ছুটে চলায়, আর রাস্তাজুড়ে গাড়ির হর্নের এক সমন্বিত কোরাসে। কিন্তু সেই চিরচেনা দৃশ্য এবার ঈদের ছুটিতে যেন বদলে গেছে সম্পূর্ণ। একটি রূপকথার মতো নীরব শহর এখন এই ঢাকা, যা বিস্ময়ের আবরণে মোড়া এক অচেনা চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঈদের অবকাশে।
২০২৫ সালের ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অধিকাংশ চাকরিজীবীরা পেয়েছেন ১০ দিনের দীর্ঘ ছুটি। রাজধানীবাসীর অনেকেই এই সুযোগে পরিবারসহ শহর ছেড়ে চলে গেছেন নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে—প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে। আর তাদের এই ব্যাপক ‘ঢাকা ত্যাগের’ ফলে রাজধানী যেন পায়নি ঈদের সেই চিরচেনা কোলাহল। বরং শহরের রাজপথ, মোড়, বাসস্ট্যান্ড, মার্কেট এলাকা—সব জায়গায় নেমে এসেছে নিরবতার আবরণ।
শনিবার ঈদের সকালে রাজধানীর প্রধান প্রধান এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে—ফার্মগেট, শাহবাগ, মতিঝিল, কারওয়ান বাজার, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, কল্যাণপুর কিংবা নিউমার্কেট—সব জায়গাতেই মানুষের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ট্রাফিক পুলিশরা অলস সময় কাটাচ্ছেন, যানজট নিয়ন্ত্রণে তাদের আজ কোনো হিমশিম নেই। বাসস্ট্যান্ডগুলোতে মানুষের অপেক্ষার চেয়ে বেশি চোখে পড়েছে ফাঁকা বেঞ্চ আর অবহেলিত চায়ের দোকান।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ঈদের সকালে দাঁড়িয়ে ছিলেন জহিরুল ইসলাম নামের একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “ঢাকায় এমন ফাঁকা রাস্তা জীবনে দেখি নাই। এমন শান্ত পরিবেশ যদি সারা বছর থাকত, তাহলে এ শহর বাসযোগ্যই হতো। মনে হচ্ছে অন্য কোনো শহরে এসে দাঁড়িয়েছি।”
তার মতো আরও কয়েকজন ভ্রমণপিপাসু নগরবাসী বলেন, যারা ঈদে ঢাকা ছাড়েননি, তাদের জন্য এ সময়টুকু যেন এক নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকার মতো। ট্রাফিক নেই, শব্দ নেই, জট নেই—সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী এক অভিজ্ঞতা।
যদিও রাস্তাঘাট ফাঁকা, কিন্তু তাতেও যানবাহনের দেখা পাওয়া সহজ হচ্ছে না। মতিঝিল থেকে কল্যাণপুরমুখী বাস ধরতে এসে অপেক্ষারত যাত্রী জামাল হোসেন বলেন, “বাস পেতে অনেক সময় লেগেছে। গাড়ি নেই, যাত্রীও নেই। সবার মন যেন ঈদের আমেজে ভাসছে। এমন একটা ফাঁকা শহর জীবনে খুব কমই দেখি।”
তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, অনেক বাস আজ চলাচল করছে সীমিত পরিসরে। চালক ও সহকারীরা ঈদের নামাজ আদায় করে বের হয়েছেন রাস্তায়, কিন্তু যাত্রী না থাকায় তাদের বেশিরভাগ সময়ই ফাঁকা গাড়ি চালাতে হচ্ছে।
মতিঝিলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসের হেল্পার রাসেল বলেন, “আজ ঈদের দিন। যাত্রী নেই বললেই চলে। আমরা সকালে নামাজ পড়ে বের হয়েছি। কোরবানির ব্যস্ততার কারণে অনেকেই বাসে উঠছেন না। বিকেলের দিকে যাত্রী বাড়তে পারে।”
অল্পসংখ্যক যাত্রী পেলেও কিছু চালক ও হেল্পাররা ‘ঈদ উপলক্ষে বখশিশ’ চেয়ে বাড়তি ভাড়া নিচ্ছেন। যদিও যাত্রীদের কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত হলেও, অধিকাংশই তা ভালোভাবেই নিয়েছেন।
জামাল হোসেন জানান, “বাসে উঠতেই হেল্পার বলল, ভাই, আজ ঈদের দিন। ১০ টাকা বাড়তি দিবেন না? আমি বললাম, ঈদের খুশি তো সবার। খুশি হয়ে দিয়ে দিলাম।”
এমন আন্তরিকতায় শহরের চেনা গম্ভীর পরিবেশেও যেন কিছুটা মানবিকতা মিশে যাচ্ছে। বিশেষ করে এই কয়েকটা দিন—যখন সবাই চেষ্টা করেন আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে।
প্রবীর দাশের তোলা একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, একদম ফাঁকা একটি প্রধান সড়কে হালকা রোদে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গাছ আর দূরে দেখা যাচ্ছে ছায়াস্নাত ভবন। নেই গাড়ি, নেই কোলাহল। এই ছবি যেন আজকের ঢাকার প্রতীক—একটি শূন্য অথচ সৌন্দর্যে ভরা নগর।
ঢাকা সবসময় ব্যস্ত। সে ব্যস্ততা বহু মানুষের জীবিকার অংশ, অনেকের জীবনের অনিবার্য চাপ। কিন্তু এই ঈদের ছুটিতে রাজধানী যেন সবাইকে দেখিয়ে দিল—একটি শহর শুধু ইট-পাথর আর যানজটের নাম নয়। যখন মানুষ সরে যায়, তখন সেই শহরেরও একটা নিরব অস্তিত্ব থাকে—যেখানে বাতাস থাকে ধূলিমুক্ত, রাস্তা থাকে অবরুদ্ধমুক্ত, আর মন থাকে চাপমুক্ত।
এই কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা নগরবাসীর মনে রেখে যাবে এক চিরস্মরণীয় স্বস্তির অনুভূতি—একটিবারের জন্য হলেও তারা পেয়েছে এক ভিন্ন, অচেনা, অথচ কাঙ্ক্ষিত ঢাকাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ