
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে তার সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে গেছে। আর এ সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন।
শনিবার (৭ জুন) এক সাক্ষাৎকারে এনবিসি নিউজের সাংবাদিক ট্রাম্পকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, মাস্কের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক কি এখন শেষ? জবাবে ট্রাম্প এক কথায় বলেন, “হ্যাঁ, আমি তা-ই ধরেই নিচ্ছি।” এরপর তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কি চান এই সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হোক? ট্রাম্প সেই প্রশ্নেরও সরল এবং কঠোর উত্তর দেন, “না।”
এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাস্কের সঙ্গে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বাকযুদ্ধ নতুন মাত্রা পেল। দুজনই মার্কিন রাজনীতির প্রভাবশালী মুখ, আর মাস্ক ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।
টেসলা, স্পেসএক্স, নিউরালিংক ও এক্সের (পূর্বের টুইটার) মালিক ইলন মাস্ক এক সময় ট্রাম্পের অন্যতম বড় দাতা ছিলেন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় মাস্ক ট্রাম্পের প্রচারণায় বড় অঙ্কের অর্থসাহায্য করেছিলেন। এমনকি ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক বিষয়ক উপদেষ্টার ভূমিকায়ও আমন্ত্রণ জানানো হয়। হোয়াইট হাউসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মাস্ককে দেখা গেছে সেই সময়।
তবে ২০২0 সালের পর থেকে দুজনের সম্পর্ক ঠান্ডা হতে শুরু করে। বিশেষ করে ট্রাম্পের জলবায়ু বিষয়ক নীতির বিরোধিতা করে মাস্ক প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেন।
সম্প্রতি ট্রাম্প কংগ্রেসে যে কর ও ব্যয় বিল পাস করিয়েছেন, সেটিকে ইলন মাস্ক ‘জঘন্য’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বিল দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। তার মতে, বিলটি করদাতাদের ওপর ‘অযৌক্তিক চাপ’ তৈরি করবে এবং প্রযুক্তিনির্ভর খাতগুলোর জন্য এটি অত্যন্ত নেতিবাচক বার্তা দেবে।
এই বক্তব্যে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “দেখুন, ইলনের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। জানি না সেটা আর থাকবে কি না। আমি ভীষণ হতাশ। কারণ, এখানে উপস্থিত অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে ইলন এই বিলের খুঁটিনাটি সবচেয়ে ভালো জানতেন। হঠাৎ করে তিনি এটিকে ‘জঘন্য’ বলছেন—যেটা বিস্ময়কর।”
ট্রাম্পের বক্তব্যের পরপরই মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (এক্স-ই তার মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্ম) একাধিক পোস্টে ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন। যদিও তিনি কোনো প্রমাণ হাজির করেননি, তবুও তিনি দাবি করেন, “ট্রাম্প ‘এপস্টেইন ফাইল’-এ জড়িত।” মাস্কের এই বক্তব্য মার্কিন মিডিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
জেফ্রি এপস্টেইনের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা বিতর্ক রয়েছে। যদিও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, তবে এপস্টেইনের সঙ্গে তার বিভিন্ন সময়কার ছবি এবং কিছু সামাজিক যোগাযোগের প্রমাণ বহুবার আলোচনায় এসেছে।
মাস্কের ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্টগুলো ইঙ্গিত দেয়, হয়তো তার হাতে এমন কিছু তথ্য আছে যা ভবিষ্যতে ট্রাম্পের জন্য বিব্রতকর হতে পারে। তবে এ নিয়ে ট্রাম্প পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো জবাব এখনো আসেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, মাস্ক ও ট্রাম্পের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির পেছনে রয়েছে উভয়ের রাজনৈতিক উচ্চাশা ও পরস্পরের আধিপত্য নিয়ে সংঘাত। মাস্ক একদিকে ট্রাম্পের মতানুযায়ী রিপাবলিকানদের সমর্থন করলেও, অন্যদিকে তিনি নিজেকে স্বাধীন চিন্তার মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প চান তার সাবেক ঘনিষ্ঠদের সবাই তার রাজনৈতিক ক্যাম্পে থাকুক এবং পুরোপুরি আনুগত্য দেখাক। মাস্কের প্রকাশ্য সমালোচনায় ট্রাম্প নিজেকে আক্রমণের শিকার মনে করছেন।
এই পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে দুজনের বিরোধ আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও মাস্ক সরাসরি রাজনীতিতে জড়াননি, তবে তার আর্থিক অনুদান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনবিসিকে দেওয়া ট্রাম্পের সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট বক্তব্য ছিল—“আমাদের সম্পর্ক শেষ, এবং আমি সেটা ফিরে পেতে চাই না।”
এই বক্তব্যে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এক সময়ের মিত্র এখন হয়ে উঠেছেন প্রকাশ্য শত্রু। তবে রাজনীতি এবং ব্যবসার অঙ্গনে বন্ধুত্ব যেমন দ্রুত তৈরি হয়, তেমনি মুহূর্তেই তা ভেঙেও যায়। ফলে এই সম্পর্ক চিরতরে ভেঙে গেছে কিনা, তা সময়ই বলবে।
তবে আপাতত ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নতুন এক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে—যার প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ