
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনেও গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। শনিবার (৭ জুন) গাজার বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত এসব হামলায় অন্তত ৬৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত ও আরও বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে রয়েছে শিশু, নারী ও প্রবীণসহ অসংখ্য নিরীহ নাগরিক। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও চিকিৎসা সূত্রে নিশ্চিত হয়েছে।
আলজাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা সিটির সাবরা এলাকায় একক হামলাতেই কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ ওই হামলাকে ‘সম্পূর্ণ গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং এ ঘটনায় গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অনেক ফিলিস্তিনি আটকা পড়ে আছে বলে জানা গেছে, যারা উদ্ধারকর্মীদের সহায়তা ছাড়া জীবিত উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
দেইর আল-বালাহ থেকে আলজাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি বলেন, “গাজা সিটিতে সাঁজোয়া হামলার পর, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিরা জীবিত উদ্ধার করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। সিভিল ডিফেন্স ও উদ্ধার দলগুলো নিরলসভাবে মৃতদেহ উদ্ধার এবং আহতদের উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে।”
অন্যদিকে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিসে অবরুদ্ধ আল-আমাল হাসপাতালটি বর্তমানে ‘পৌঁছানোর অযোগ্য’ হয়ে পড়েছে। ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্টের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী আশেপাশের এলাকা ‘ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে ঘোষণা করে সেখানে বসবাসরতদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এতে হাসপাতালে থাকা অসংখ্য রোগী ও চিকিৎসক বিপন্ন অবস্থায় পড়েছেন।
ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা দ্রুত হস্তক্ষেপ করে চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং ত্রাণ ও চিকিৎসাসামগ্রীর নিরাপদ প্রবাহের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
হামলায় নিহতদের মধ্যে আটজনের মৃত্যু হয়েছে একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে গুলিবর্ষণের কারণে। এই ঘটনাটি গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফার পশ্চিমে ঘটে। উল্লেখ্য, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাফার আল-আলম গোলচত্বরে প্রতিদিন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ত্রাণ সংগ্রহের জন্য জড়ো হচ্ছেন।
ত্রাণকেন্দ্রের কাছে গুলিবর্ষণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সামির আবু হাদিদ নামের এক ব্যক্তি। তিনি এএফপিকে বলেন, “হাজার হাজার মানুষ গোলচত্বরের কাছে জড়ো হয়েছিল। ইসরায়েলি সাঁজোয়া যান থেকে প্রথমে আকাশে গুলি চালানো হয় এবং পরে বেসামরিক মানুষের দিকে গুলিবর্ষণ করা হয়।”
ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিরা সাহায্য গ্রহণের জন্য এসেছিল। কিন্তু এ হামলায় নিহত হওয়া লোকজনের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সেই ত্রাণ নিতে আসা নিরীহ বেসামরিকরা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখনও পর্যন্ত এই গুলিবর্ষণের ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
গাজার অবস্থা দিনদিন আরও সংকটময় হচ্ছে। গত মে মাসের শেষ থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি হামলা এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সংঘাত অব্যাহত থাকায় এ পর্যন্ত শত শত প্রাণহানি ঘটেছে। চলমান সংঘাতের কারণে গাজার বাসিন্দারা ব্যাপক দুর্ভোগে রয়েছে। চলমান বোমাবর্ষণ, বিদ্যুৎ ও পানির সংকট এবং চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ার ফলে মানুষের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে উঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয় পক্ষকেই শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে। গাজার হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা চালু রাখতে ত্রাণ সামগ্রী ও ওষুধের নিরাপদ প্রবাহ নিশ্চিত করা এখন সময়ের অন্যতম প্রধান দাবি।
বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ মিছিল করছে এবং দ্রুত সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানাচ্ছে। তবে ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকায় গাজায় নতুন মাত্রার মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।
ফিলিস্তিনি নাগরিকদের জীবন রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে, গাজায় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ আরও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। গাজা উপত্যকার বর্তমান সংকটের সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এখন প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, ঈদুল আজহার পবিত্র দিনে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের মর্মান্তিক পরিণতি কীভাবে প্রতিরোধ করা হবে, এবং বিশ্বের মানবতা ও ন্যায়ের দাবিকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হবে। গাজার কোটি মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তির প্রত্যাশায় দিন গুনছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ