
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ—যা বিগত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ, এটিও একটি রেকর্ড নিম্ন হার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, বাণিজ্য যুদ্ধ ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং আন্দোলন-পরবর্তী অস্থিতিশীলতা, ডলার সংকট ও বিনিময় হার বৃদ্ধি, সুদের হার বাড়তি চাপ, চড়া মূল্যস্ফীতি এবং সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে ঋণ প্রবাহ সীমিত হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সামগ্রিক ঋণ প্রবাহ কমলেও উৎপাদনমুখী খাতগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ তহবিল থেকে ঋণ সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন এখনো কিছুটা ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের সার্বিক অবস্থান দুর্বল হওয়ায় বিনিয়োগের নতুন প্রবণতা সৃষ্টি হয়নি।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) জানিয়েছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ রেকর্ড পরিমাণে কমা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তাদের মতে, টানা কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা অব্যাহত থাকায় নতুন শিল্প স্থাপনা হচ্ছে না, বিদ্যমান শিল্পগুলোও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। সরকারি খাতেও চিত্র একই; সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়লেও তা মূলত দৈনন্দিন খরচে ব্যয় হচ্ছে, বিনিয়োগে নয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “এক-দুই মাসের জন্য ঋণপ্রবাহ কমতে পারে। কিন্তু টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কমতে থাকলে বুঝতে হবে খাতটি সমস্যাকবলিত। বেসরকারি খাতে প্রবাহ সর্বনিম্নে নেমে গেছে, এর সরাসরি প্রভাব শিল্প-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানে পড়ছে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেকর্ড বলছে, ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। একই সময়ে সামগ্রিক ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ২৭ দশমিক ৪০ শতাংশে। ওই সময়টি ছিল অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির শীর্ষকাল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত। বিদায়ী অর্থবছরে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশে, যা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
অন্যদিকে, সরকারি খাতে ঋণের সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে, যখন করোনা মহামারির কারণে রাজস্ব আয় কমে গিয়েছিল। সে সময় সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৫৯ দশমিক ৯২ শতাংশে।
২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া করোনার অভিঘাতের পর এক বছর ঋণ প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও পরবর্তী সময় থেকে আবার নিম্নগামী হয়েছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি নতুন করে চাপে পড়ে। তেলের দাম, গমসহ খাদ্যশস্যের দাম এবং জাহাজভাড়ার বৃদ্ধি সরাসরি বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট তৈরি হয়, যা ঋণপ্রবাহকেও প্রভাবিত করে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আন্দোলন-পরবর্তী অস্থিরতা। ডলার-সংকট এবং সুদের হার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি খাত নতুন ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত হয়েছে। এতে বিনিয়োগ কমে গেছে, যা দেশের কর্মসংস্থানের বাজারকে সংকটে ফেলেছে।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা গিয়েছে বেসরকারি খাতে, যা মোট ঋণ প্রবাহের প্রায় ৭৭ শতাংশ। বাকি ৫ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা সরকারি ও অন্যান্য খাতে গেছে।
অতীতের প্রবণতা অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়লে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। আবার এ খাতে প্রবাহ কমে গেলে সার্বিক ঋণপ্রবাহও নেমে আসে। ফলে বর্তমান সংকটকে অর্থনীতির জন্য অতি গুরুতর হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের বাজারে যে ভাটা চলছে তা আরও দীর্ঘায়িত হবে। নতুন শিল্প স্থাপন না হলে কিংবা বিদ্যমান শিল্প সম্প্রসারণ না হলে আগামী কয়েক বছরে তরুণদের চাকরির বাজার মারাত্মক চাপে পড়বে।
তাদের মতে, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখন মূল কাজ হওয়া উচিত বেসরকারি খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা। সুদের হার স্থিতিশীল রাখা, ডলার সংকট মোকাবিলা এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারলে এ খাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
সর্বশেষ প্রতিবেদনগুলো স্পষ্ট করে দিচ্ছে—বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক ধরনের “ঋণ সংকটে” আছে। সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া মানে হলো শিল্প-বাণিজ্যে গতি নেই, কর্মসংস্থান বাড়ছে না এবং বিনিয়োগ ঝিমিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে হলে জরুরি ভিত্তিতে নীতি সহায়তা, বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা এবং অর্থনৈতিক আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে অর্থনীতি চাকা ঘুরলেও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা কাটবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ