
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা পুলিশ প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মগবাজার, সাভার, নিউমার্কেট, বসিলা, এমনকি খুলনার ফুলতলা পর্যন্ত একের পর এক সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে—যার ভিডিও ফুটেজ প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাই বলছেন, যদি বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আইনশৃঙ্খলার চিত্র আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। ইতোমধ্যে ঢাকার অনেক এলাকাই কার্যত পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হওয়া সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার অভিযোগ, জেলা ও বিভাগীয় আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে পুলিশকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্থানীয়ভাবে সংগঠিত মব ভায়োলেন্স, দুর্বৃত্তদের পুলিশকে ভয় না পাওয়া এবং রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে অপরাধীরা একপ্রকার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তারা দ্রুত জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের ‘মানবিক পুলিশিং’ নীতির অপব্যবহার করে একটি চক্র এখন সন্ত্রাস ও সহিংসতার মাধ্যমে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রশাসনিক ও মানবাধিকার সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ছে।
গত কয়েক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া কিছু গুরুতর ঘটনার মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেশের ভয়াবহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। উদাহরণস্বরূপ:
২৬ মে রাত, বাড্ডার গুদারাঘাটে গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, দুই যুবক পেছন থেকে এসে তাকে গুলি করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
একইদিন, মগবাজারে চাপাতি দিয়ে এক তরুণের উপর হামলা চালিয়ে ছিনতাই করে অপরাধীরা। ভুক্তভোগী আবদুল্লাহ কুমিল্লার বাসিন্দা। সে ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় তিনজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
১৯ মে, সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় শাহীন (৩০) নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
১৮ মে, নিউমার্কেটের সেন্ট্রাল রোডে সাইফ হোসেন মুন্না নামের এক যুবককে (কলাবাগান ওয়ার্ড বিএনপি কর্মী) প্রকাশ্যে কোপানোর ভিডিও ভাইরাল হয়। ঘটনাটি ঘটে দিনের আলোয়, প্রকাশ্য রাস্তায়।
১৫ মে, মোহাম্মদপুরের বসিলা সিটি হাউজিং এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে ছিনতাই চালায়। ঘটনাস্থলে গণপিটুনিতে রাকিব নামে এক ছিনতাইকারী নিহত হয়।
২২ এপ্রিল, খুলনার ফুলতলায় মোটরসাইকেলে চড়ে দুর্বৃত্তরা সুমন মোল্লা নামের এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে।
২৫ ফেব্রুয়ারি, কাওরান বাজার রেললাইনের পাশে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে এক মাদক কারবারিকে ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, অস্ত্রধারী কয়েকজন দুর্বৃত্ত পুলিশের ওপর চাপাতি দিয়ে হামলা চালায় এবং হাতকড়া পরানো আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।
এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক চরমে পৌঁছেছে। অনেকে বলছেন, সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন, কারণ সড়কে এখন আর কেউ নিরাপদ নন।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশব্যাপী ৬০ হাজারেরও বেশি মামলা হয়েছে। শুধু এপ্রিলেই মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৩৬৮টি, যার মধ্যে হত্যা মামলা ৩৩৬টি, ডাকাতি ৪৬টি, দস্যুতা ১৪৯টি, অপহরণ ৮৮টি এবং চুরি ৭১৫টি।
ডিএমপি (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ) এলাকায় এপ্রিল মাসে মামলা হয়েছে ১,৫৪৭টি। জানুয়ারিতে ছিল ১,৭৯১টি, ফেব্রুয়ারিতে ১,৫৬৬টি, মার্চে ১,৭৫৪টি। এই সংখ্যা প্রতিমাসেই উদ্বেগজনক। পাশাপাশি গত ২৪ দিনে পুলিশের ওপর হামলার ২৩টি ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশের অবস্থান: নজরদারি বাড়ানো হলেও অপরাধ থামছে না
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানান, “সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে আমরা নজর রাখছি। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরপরই অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে অনাকাঙ্খিত ঘটনা রোধে পুলিশি তৎপরতা আরও বাড়ানো হয়েছে।”
তবে এক পুলিশ সুপার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে চায় না। মানবিক পুলিশিং করার নির্দেশনা আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। যে দেশে নিজের সম্পদ নিজেই মানুষ ধ্বংস করে, সেখানে শুধু নরম কথা বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সম্ভব নয়।”
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য ‘রুটিন কাজ’-এর বাইরে কিছু করছেন না। অপরাধীদের বিষয়ে আগাম কোনো তথ্য নেই, গোয়েন্দা তৎপরতাও শিথিল। একের পর এক বড় বড় অপরাধ ঘটছে, কিন্তু নেই কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা বা অভিযানের কার্যকর ফলাফল।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু ‘ঘটনার পর’ ব্যবস্থা নয়, ‘ঘটনার আগেই’ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে না পারলে শিগগিরই রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরগুলো অপরাধের নগরীতে পরিণত হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিক জীবনে নিরাপত্তার অভাব একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা, অপরাধীদের দুঃসাহস, পুলিশ বাহিনীর সীমাবদ্ধতা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি। যদি এখনই কঠোর, সমন্বিত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে আইনশৃঙ্খলার এমন অবনতির পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ