
ছবি: সংগৃহীত
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে সচিবালয়ের ভেতরে টানা তৃতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অসংখ্য কর্মচারী। বিতর্কিত এই অধ্যাদেশকে ‘কালাকানুন’ ও ‘নির্বিচার ক্ষমতার অপপ্রয়োগের পথ উন্মুক্তকারী আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তারা বলেছেন, এই আইন বাস্তবায়ন হলে তাদের চাকরির নিরাপত্তা চরমভাবে হুমকির মুখে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে আজ সোমবার দুপুর ২টায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল আন্দোলনরত কর্মচারীদের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠকে বসছেন বলে নিশ্চিত করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
বেলা ১১টার দিকেই সচিবালয়ের দক্ষিণ প্রান্তের বাদামতলায় জড়ো হতে থাকেন শত শত সরকারি কর্মচারী। মিছিল, ব্যানার ও স্লোগানে তারা ‘অধিকার ফিরে চাই’, ‘কালাকানুন মানি না’, ‘চাকরি বাঁচাও—অধিকার বাঁচাও’ ইত্যাদি স্লোগান তুলে আন্দোলনকে আরও দৃশ্যমান করে তোলেন।
এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা অভিযোগ করেন, ২০২৫ সালের সংশোধিত সরকারি চাকরি অধ্যাদেশটি মূলত ১৯৭৯ সালের একটি বিতর্কিত অধ্যাদেশের পুনরুজ্জীবন, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এরপরও বর্তমান সরকার সেই একই আইনকে কিছু পরিবর্তন এনে ফের কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে, যা গণতান্ত্রিক নীতিমালার বিরুদ্ধে। তারা বলেন, সংশোধিত এই আইন বাস্তবায়িত হলে কোনো প্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই কর্মকর্তা বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
বিক্ষোভকারী কর্মচারীরা দাবি করছেন, নতুন অধ্যাদেশে চাকরির স্থায়িত্ব, শৃঙ্খলা ও ন্যায্যতার ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই। এটি মূলত প্রশাসনিক কর্তৃত্বের মাধ্যমে চাকরির নিরাপত্তা হরণ করার একটি চক্রান্ত। তারা আরও বলেন, এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন হলে সরকারি কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ক্ষোভ, পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ কিংবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে চাকরি হারাতে পারেন। এতে দেশের লক্ষাধিক সরকারি কর্মচারী এক ধরনের ‘দাসত্বের শৃঙ্খলে’ আবদ্ধ হয়ে পড়বেন।
বিক্ষোভরত কর্মচারীদের একাংশ জানিয়েছেন, সরকার যদি শিগগিরই এই অধ্যাদেশ বাতিল না করে, তাহলে তারা আন্দোলন আরও তীব্রতর করবেন। এমনকি আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন আন্দোলনরত কর্মচারীরা। তাদের মতে, এর মাধ্যমে তারা সরকারের প্রতি কঠোর বার্তা দিতে চান যে, কর্মচারীদের স্বার্থ উপেক্ষা করে কোনও কালো আইন চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রশমনে এবং সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে উদ্যোগ নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। সূত্র জানিয়েছে, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল নিজেই সচিবালয়ে উপস্থিত থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরাসরি সংলাপে বসবেন। এই বৈঠকে আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো গুরুত্ব সহকারে শোনা হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে সম্ভাব্য পথ বের করার চেষ্টা থাকবে বলে জানা গেছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, “আমরা পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাই না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের চাকরির নিরাপত্তা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কর্মচারীদের আস্থা ফেরাতে আমরা সরাসরি আলোচনা শুরু করছি।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৫ সালের চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ঘিরে সৃষ্টি হওয়া এই উত্তেজনা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ইস্যু নয়—এটি গভীর রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে। কর্মচারীদের সমবেত প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন নানা দিক থেকে সরকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের বৈঠকের ফলাফলের উপর। যদি আলোচনা ইতিবাচক হয় এবং সরকার কিছুটা হলেও নমনীয়তা দেখায়, তাহলে হয়তো উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে। অন্যথায়, সচিবালয় তথা প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড আরও বড় ধরনের অচলাবস্থার মুখে পড়তে পারে, যা সরকারের ওপর বিপুল চাপ সৃষ্টি করবে।
সার্বিকভাবে, বিক্ষোভরত কর্মচারীদের দাবির যৌক্তিকতা এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া আগামী কয়েক দিনের মধ্যে স্পষ্ট হবে। তবে আজকের বৈঠক পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মোড় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ