
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত আবারও রূপ নিয়েছে অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের গোপন করিডরে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, সীমান্তের সাতটি পথ এখন অস্ত্র পাচারের সক্রিয় রুটে পরিণত হয়েছে। এসব পথে নিয়মিতভাবে মায়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আসছে বাংলাদেশে, যার মূল গন্তব্য কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির ও তিন পার্বত্য জেলার (বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি) সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আস্তানা।
তথ্য বলছে, মায়ানমার থেকে অস্ত্র পাচারে অন্তত পাঁচটি বড় চক্র সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি চক্রেই রোহিঙ্গা সদস্যদের উপস্থিতি রয়েছে, আর তারা কাজ করছে আন্তর্জাতিক মাদক ও মানবপাচার নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগসাজশে। শুধু অস্ত্র নয়—একই রুট ব্যবহার হচ্ছে ইয়াবা ও আইস পাচারের ক্ষেত্রেও। ফলে সীমান্তবর্তী এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দীন শাহীন জানান, সম্প্রতি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের মরাগাছতলায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ দুটি আগ্নেয়াস্ত্র, পাঁচ রাউন্ড কার্তুজ ও দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ পাঁচজনকে আটক করেছে। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, তারা অস্ত্র ও মাদক একসঙ্গেই পাচার করছিল এবং এই চালানটি এসেছিল মায়ানমার সীমান্ত থেকে।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সীমান্তের একদম কাছাকাছি হওয়ায় মায়ানমার থেকে অস্ত্র আনা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। পাচারকারীরা রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি পথ ও নাফ নদী ব্যবহার করে অস্ত্র ঢুকাচ্ছে।”
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) রামু সেক্টরের কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, মায়ানমার থেকে অস্ত্র ঢোকার পর প্রথমেই তা পৌঁছে দেওয়া হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। পরে সেখান থেকে অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে পার্বত্য এলাকায় অবস্থানরত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে।
তিনি বলেন, “আমরা গত তিন মাসে ২২টিরও বেশি দেশি-বিদেশি অস্ত্রের চালান আটক করেছি। সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে।”
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মায়ানমার ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তজুড়ে সাতটি রুটে অস্ত্র পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় পথগুলো হলো—
-
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি,
-
বালুখালী কাস্টমস ঘাট,
-
উখিয়ার পালংখালী ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নলবনিয়া,
-
টেকনাফের উনচিপ্রাং, উলুবনিয়া, হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা-দমদমিয়া-জাদিমুরা-নয়াপড়া এবং বরইতলী খাল।
বিশেষত বাইশফাঁড়ি অঞ্চলটি পাহাড়ি ও দুর্গম হওয়ায় সেখানে স্থানীয় চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্যও এই অস্ত্র বাণিজ্যে যুক্ত রয়েছে। এখান দিয়ে আনা অস্ত্রের বেশির ভাগই যায় তিন পার্বত্য জেলায় সক্রিয় সন্ত্রাসীদের হাতে, আর টেকনাফ-উখিয়ার দিকের রুটগুলো দিয়ে অস্ত্র পৌঁছায় বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।
স্থানীয় সূত্র বলছে, টেকনাফের জাদিমুরা পয়েন্টে কালু নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সরাসরি এই ব্যবসায় জড়িত। এই পুরো চক্রের হাত এতটাই লম্বা যে, সীমান্তের দুপাশের দুষ্কৃতকারীরা এখন একে অপরের সহযোগী হয়ে উঠেছে।
তদন্তে জানা গেছে, অস্ত্র বাণিজ্যের পেছনে কাজ করছে পাঁচটি বড় চক্র। এর মধ্যে চারটি চক্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সশস্ত্র সংগঠন—
১. আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)
২. রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)
৩. হালিম গ্রুপ (নেতৃত্বে কেফায়েত উল্লাহ ওরফে আব্দুল হালিম)
৪. নবী হোসেন গ্রুপ
এ ছাড়া খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের অরণ্যে সক্রিয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোও এই অস্ত্র পাচার চক্রের ক্রেতা ও সহযোগী। এদের মোট সদস্যসংখ্যা শতাধিক বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় গ্রুপ হলো হালিম গ্রুপ। উখিয়ার কুতুপালংয়ের ক্যাম্প-৭-এ তাদের প্রধান আস্তানা। স্থানীয়রা জানান, গ্রুপের নেতা কেফায়েত উল্লাহ ওরফে হালিম ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে দেখা যায়, তিনি মায়ানমারের রাখাইনের ঢেকিবনিয়া এলাকায় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি)-এর ঘাঁটি থেকে লুট করা অস্ত্র প্রদর্শন করছেন। ওই অস্ত্রগুলো পরে চোরাই পথে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।
র্যাব-১৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল হাসান জানান, “গত দেড় বছরে র্যাবের অভিযানে ২১টি বিদেশি অস্ত্রসহ এক হাজার ২৭৯টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। একই সময় ১৬৩ জন অস্ত্রধারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” তিনি বলেন, এই অস্ত্রের বড় অংশ এসেছে মায়ানমার সীমান্ত হয়ে।
২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পরই মায়ানমারে শুরু হয় নতুন এক অস্থিতিশীল অধ্যায়। ওই সময় আরাকান আর্মি নামের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন রাখাইন রাজ্যকে মায়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের সঙ্গে মায়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ ভয়াবহ আকার নেয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তারা সীমান্তসংলগ্ন রাখাইনের বড় অংশ ও বহু বিজিপি ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এ সময় মায়ানমারের শত শত সেনা ও বিজিপি সদস্য প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এই সংঘর্ষের ফাঁকে আরাকান আর্মির দখলে থাকা অস্ত্রের বড় অংশ লুটে নেয় রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো—বিশেষ করে আরসা ও আরএসও। পরে এই অস্ত্র পাচার হয় বাংলাদেশের অপরাধী নেটওয়ার্কের হাতে। এমনকি সীমান্তে খাদ্য সংকটের কারণে আরাকান আর্মি নিজেও অস্ত্র বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশের পাচারকারীদের কাছে, বিনিময়ে তারা পেত চাল, ডাল, তেল ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় জামায়াত নেতা তোফাইল আহমদ সম্প্রতি এক সভায় বলেন, “সীমান্ত দিয়ে এখন এত নিত্যপণ্য আরাকানে যাচ্ছে যে, কক্সবাজারের হাজী বিরিয়ানিই নাকি আরাকান আর্মির সকালের নাশতা।”
এই বক্তব্যই সীমান্তের ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরে। নিত্যপণ্যের বিপরীতে অস্ত্র আসছে, আর এই বাণিজ্য এখন একটি সমান্তরাল অর্থনীতিতে রূপ নিয়েছে—যা একদিকে মাদক ও সন্ত্রাসকে শক্তিশালী করছে, অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য তৈরি করছে গভীর উদ্বেগের পরিবেশ।
সীমান্তে মায়ানমারের সংঘর্ষ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধচক্র ও পার্বত্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যোগসাজশে অস্ত্র পাচার এখন জাতীয় নিরাপত্তার বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সক্রিয় নজরদারি চালাচ্ছে, তবু এই জটিল ও বহুস্তরীয় চক্রকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে সীমান্তজুড়ে সমন্বিত গোয়েন্দা অভিযান ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
সীমান্তের সাত পথ এখন শুধু অস্ত্র নয়—মাদক, মানবপাচার আর সন্ত্রাসের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ