
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলমান সংকটের কেন্দ্রে এখন শিল্প খাত। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছিল, সেটি একদিকে সাময়িকভাবে ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করলেও, অপরদিকে দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কর্মসংস্থান খাতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি হ্রাস পাওয়ায় শিল্প উৎপাদন কমেছে, যার ফলে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে, কমেছে চাকরির সুযোগ, বেড়েছে বেকারত্ব এবং ব্যাহত হচ্ছে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি।
রিজার্ভ বাঁচাতে আমদানি রুদ্ধ, ধাক্কা খেয়েছে শিল্প
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ সংকট মোকাবেলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে ছিল উচ্চ আমদানি শুল্ক, এলসি (ঋণপত্র) খোলায় কঠোরতা, বিশেষ করে বিলাসবহুল পণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে। এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানিতে হঠাৎ করে পতন ঘটলেও শিল্প খাতের জন্য এটি একপ্রকার আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। যেসব শিল্প কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাদের উৎপাদন কার্যক্রম হোঁচট খায়। ডলার সংকটে কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনতে না পারায় উৎপাদন কমিয়ে দেয়, কেউ কেউ সাময়িকভাবে বন্ধও করে দেয়।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। যন্ত্রপাতি আনতে পারছে না শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কারখানায় জ্বালানি সংকট চলছে, ব্যাংকের সুদহার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়—এমন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কেউ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। বরং উদ্যোক্তারা বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন।”
আরেকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেছেন, “দেশে এখন মন্দার পরিবেশ। উৎপাদন খাতে অস্বাভাবিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। রপ্তানি খাতে বিপর্যয় এবং দেশীয় বাজারে ক্রমবর্ধমান চাহিদার অভাব, এ সবের প্রভাব পড়ছে শিল্পের উৎপাদন এবং ব্যবসায়ীক শৃঙ্খলায়। আমদানি সংকোচন যদি চলতে থাকে, তবে এই খাতের সংকট আরও তীব্র হবে।”
বিনিয়োগ স্থবির, বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধিতে ২১ বছরের রেকর্ড পতন
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৬.৮২ শতাংশে—যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর ফলে স্পষ্ট যে, উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন এবং ব্যাঙ্কগুলোও আগের মতো ঋণ দিতে পারছে না। ঋণের চাহিদা কমার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিনিয়োগ অনিচ্ছা, যন্ত্রপাতি আমদানিতে বাধা এবং ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, “মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়ার ফলে শিল্প সম্প্রসারণ থমকে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কৌশল নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন না।”
শিল্প উদ্যোক্তা মনিরুজ্জামান জানাচ্ছেন, “আমরা অনেকটা স্তব্ধ হয়ে পড়েছি। ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, তা মেলে না। আর সেই কারণে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছে। একদিকে কাঁচামালের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বিক্রির উপর চাপ বাড়ছে।”
শিল্পোৎপাদনে পতন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৪.২২ শতাংশে, যা বিগত প্রায় দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.৫ শতাংশের কাছাকাছি, কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। উৎপাদন ও রপ্তানি খাতে স্থবিরতা, ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, এবং রাজস্ব ঘাটতির কারণে জিডিপির এই সংকোচন ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিনিয়োগ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় জিডিপি হ্রাস পাচ্ছে, যার পরিণতিতে সরকারের রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে এবং কর্মসংস্থানের হার মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহমেদ মুজিবুর রহমান বলেন, “দেশের শিল্প খাতের যন্ত্রপাতি আমদানি সংকটের ফলে উৎপাদন খাতে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারের উচিত দ্রুত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।”
আমদানি ও এলসির পরিসংখ্যানে আশঙ্কার ছাপ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মোট পণ্য আমদানি হয়েছে ৪,৬৪৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় সামান্য বেশি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো—এই বাড়তি আমদানি মূলত ভোগ্যপণ্যের, ঈদ উপলক্ষে বাড়তি চাহিদার কারণে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলার হার কমেছে ২৬ শতাংশ, নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্যের এলসিও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এসব তথ্য বলছে, নতুন শিল্প গড়ে ওঠা তো দূরের কথা, বিদ্যমান শিল্পই সংকোচনের মুখে।
কর্মসংস্থানের হার কমেছে, শ্রমবাজারে চাহিদা নেই
বিবিএস-এর শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৬০ হাজার, যা এক বছর আগের তুলনায় ১ লাখ ৭০ হাজার বেশি। একই সঙ্গে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমেছে ১৯ লাখ ৫০ হাজার। এর অর্থ হলো, কাজের সুযোগ না থাকায় অনেকে চাকরির সন্ধানই বন্ধ করে দিয়েছেন। এই শ্রমবাজার সংকোচন প্রবৃদ্ধির বিপরীতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কর্মসংস্থান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুর রহমান বলেন, “বর্তমানে শ্রমবাজারে শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, এর ফলে বেকারত্বের হার বেড়েছে এবং অনেক দক্ষ কর্মী দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রয়োজন সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি।”
রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে দুশ্চিন্তার শীর্ষে
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। সরকার বছরের শুরুতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করলেও তা পরে কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। সেই লক্ষ্যও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
ফরেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি জাবেদ আখতার বলেন, “বাণিজ্য বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে। কিন্তু এখন ব্যবসার পরিবেশ কঠিন, বিনিয়োগ নেই। কাস্টমস পদ্ধতিকে সহজ করা এবং কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনা জরুরি।”
উত্তরণের পথ কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সংকট থেকে বের হওয়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তার সঙ্গে প্রয়োজন ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, সুদের হার স্থিতিশীল রাখা, আমদানি নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, বিদ্যুৎ-জ্বালানির নিশ্চয়তা এবং কর প্রশাসনে সংস্কার। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের জন্য আস্থা তৈরির মতো প্রণোদনা ও সহায়তা পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দাম রুবেল বলেন, “ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিনিয়োগ করলে যে লাভ আসবে, সে বিষয়ে স্থির বার্তা দিতে হবে। ব্যাংকিং খাত, আইন-শৃঙ্খলা এবং আমদানি ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত পেলেই উদ্যোক্তারা আবার সক্রিয় হবেন।”
অর্থনীতির হাল ফিরাতে এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও দূরদর্শী নীতি কাঠামো, যাতে ডলার সংকট যেমন প্রশমিত হয়, তেমনি শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগ আবার গতি পায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ