
ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচন সামনে রেখে দেশজুড়ে একটি বিস্ময়কর দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে। নিবন্ধন পাওয়ার জন্য তৎপর হয়েছে ৬৫টি রাজনৈতিক দল, যার মধ্যে অধিকাংশই নতুন এবং নামসর্বস্ব। এর মধ্যে এমন অনেক দল রয়েছে, যাদের কোনো কার্যকরী কমিটি নেই, বা কিছু দল শুধুমাত্র কাগজে-কলমে গঠন করা হয়েছে। এমনকি, কিছু দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বা সাইনবোর্ডও নেই। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনের জন্য এসব দলের মধ্যে অনেকেই আবেদন করেছে এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন তদন্তও চলছে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে, নতুন নতুন দল গঠনের প্রবণতা দেখা গেছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন ২৪টি দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইসি থেকে ৫টি দল নিবন্ধন পেয়েছে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, এবং বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি (বিএমজিপি)। এছাড়া, সম্প্রতি নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে জনতা পার্টি বাংলাদেশ, যার চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এবং মহাসচিব সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ। একইভাবে, ২৬ এপ্রিল আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টি (বিএনজিপি), যার আহ্বায়ক মুহাম্মাদ আবদুল আহাদ নূর।
এ ধরনের দলগুলোর সৃষ্টি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে সন্দেহের কারণ হয়ে উঠেছে। তাদের মতে, যেহেতু নির্বাচনের সময় নতুন দলের আবির্ভাব বাড়ে, সেহেতু এতে রাজনৈতিক স্বার্থের গন্ধ থাকতে পারে। অনেকে এই বিষয়টিকে "ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা" বা "ক্ষমতার লড়াই" হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকরা জানান, নির্বাচনের আগে ছোট ছোট দলের উত্থান একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে এটি কোনো একটি গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হিসেবে দেখা উচিত নয়। "ব্যাঙের ছাতার মতো" এ ধরনের দল গজিয়ে ওঠা মূলত স্বার্থের জড়িত একটি প্রক্রিয়া হতে পারে। দল গঠন করতে গিয়ে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করার মানসিকতা থাকলে সেটি একে ইতিবাচক হিসেবে দেখা যেতে পারে, কিন্তু যখন দলের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র ভোটের টুকিটাকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকি হতে পারে।
সুজনের সম্পাদক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, "দল গঠন করলে দেশ ও জনকল্যাণে কাজ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগির জন্য এসব নতুন দল গঠন হতে পারে।"
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই এসব দলের নিবন্ধন যাচাই-বাছাই করতে মাঠে নেমেছে। সূত্র জানাচ্ছে, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা দলগুলোর কার্যক্রম, অফিস এবং ঠিকানা যাচাই করার জন্য নিবন্ধন সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করছে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ইসি নিবন্ধনের জন্য সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ২২ জুন পর্যন্ত দলগুলোকে সময় দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, "সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন নিয়ে পরিকল্পনা করা হবে।"
নতুন রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধন পাওয়ার জন্য ইসির শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে এমন অনেক দল রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, এবং জাস্টিস পার্টি (বাজাপা) দলগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যালয়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি অথবা সংগঠনগত কার্যক্রম যথাযথভাবে প্রমাণিত হয়নি।
বাংলাদেশ মুক্তি ঐক্যদল এর কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. নুর ইসলাম শিকদার জানান, তাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার একটি সুপার মার্কেটের দোতলায় ছিল, তবে ঝড়ে সাইনবোর্ড উড়ে গেছে। এখন তারা নতুন সাইনবোর্ড তৈরি করেছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের সভাপতি আতিকুর রহমান রাজা জানিয়েছেন, তাদের দল সারাদেশের আটটি জেলা ও ৭২টি উপজেলায় কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু এসব দল নিবন্ধন শর্ত পূরণের জন্য যথেষ্ট কার্যক্রম প্রমাণ করতে পারেনি।
এছাড়া, এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তারা মাত্র দুই মাস আগে কার্যক্রম শুরু করেছে এবং তাদের দলের গঠনতন্ত্র ও ইশতেহার চূড়ান্ত হয়নি। দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদীন শিশির বলেন, "এ বিষয়ে এখনও দলের ফোরামে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।"
ইসি সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধন প্রাপ্তির জন্য কিছু শর্ত পূরণ করা বাধ্যতামূলক। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন, ১০০টি উপজেলা বা মহানগর থানায় কার্যকরী অফিস খোলা, প্রতিটি কার্যালয়ে ২০০ ভোটারের তালিকা প্রাপ্তি, এবং দলের গঠনতন্ত্রে নির্দিষ্ট কিছু বিধান রাখা। তবে এসব শর্ত এখনও অনেক দল পূরণ করতে পারেনি।
এদিকে, আরও বেশ কিছু নামসর্বস্ব দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে "নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ", "বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি", "বাংলাদেশ শান্তির দল", "দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন" এবং "জাতীয় ভূমিহীন পার্টি" সহ আরও বেশ কিছু বাহারি নামের দল। এসব দলের অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা অবস্থায় নিবন্ধন আবেদন করেছেন এবং এখনও পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে শুরু হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, "নতুন দলগুলোকে নিবন্ধন দিতে আমাদের একটি যাচাই-বাছাই তালিকা রয়েছে। নিবন্ধনের আগে আমরা দেখব, নতুন আবেদনকারী দলগুলো তাদের শর্ত পূরণ করেছে কিনা।"
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এই নতুন দলের উত্থান একদিকে যেমন গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের উদাহরণ, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহৃত কিছু দল গঠন প্রক্রিয়াও হতে পারে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিয়ম ও শর্ত পূরণের জন্য তৎপর রয়েছে, কিন্তু দলগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ এখনও শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে কঠিন বাধার সম্মুখীন। এখন দেখার বিষয় হবে, আগামী নির্বাচনের আগে এই দলের নিবন্ধন কীভাবে কার্যকর হয় এবং কোন দলগুলো শর্ত পূরণে সক্ষম হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ