
ছবি: সংগৃহীত
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে সংঘটিত দেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ও বিতর্কিত অভিযানে নিহতদের একটি প্রাথমিক তালিকা অবশেষে প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ৯৩ জনের এই খসড়া তালিকা তাদের মধ্যে যারা প্রাণ হারিয়েছেন বলে সংগঠনটির দাবি। হেফাজতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তালিকাটি এখনো চূড়ান্ত নয় এবং যাচাই-বাছাই শেষে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ঘটনায় প্রায় এক যুগ ধরে রাষ্ট্রীয় স্তরে কোনো স্বীকারোক্তি না থাকলেও, হেফাজত বলছে—তারা ঐ রাতের নৃশংস ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং সত্য তুলে ধরার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
রোববার (৪ মে) হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বশীল মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারী সংবাদমাধ্যমকে জানান, সংগঠনটি কয়েক বছর ধরে নিরবিচারে নিহতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এবার একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে যাতে ৯৩ জন শহিদের নাম, ঠিকানা, পরিবারের সদস্যদের নাম ও পরিচয় উল্লেখ রয়েছে।
আজহারী বলেন, “এই তালিকা চূড়ান্ত নয়। আরও অনুসন্ধান চলছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, আরও অনেকে সেদিন নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে গুম হয়েছেন, নিখোঁজ রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাই আমরা প্রত্যেক শহিদের পরিচয় নিশ্চিত করে ধাপে ধাপে তথ্য প্রকাশ করবো।”
তিনি আরও জানান, দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত না হওয়ায় পরিবারগুলো বিচার বা স্বীকৃতি পায়নি। হেফাজত নিজেদের দায়িত্ব থেকে এসব তথ্য সামনে আনছে, যাতে ইতিহাসের গোপন অংশগুলো আড়াল না থেকে যায়।
২০১৩ সালের ৫ মে দিনভর রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজার হাজার হেফাজতে ইসলাম কর্মী ও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেন। তাদের দাবি ছিল ইসলাম ধর্ম ও নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকারী ব্লগারদের বিচার, নারী উন্নয়ন নীতির বাতিল, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা, ইসলামবিরোধী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বন্ধসহ মোট ১৩ দফা।
রাত গভীর হওয়ার পর, সরকার হঠাৎ অভিযান চালায়। রাত ২টা থেকে ভোররাত পর্যন্ত চলে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি’র যৌথ অভিযান। ব্যবহার করা হয় টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট এমনকি অভিযোগ রয়েছে, সরাসরি গুলিও চালানো হয়। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, গণমাধ্যমের প্রবেশ ঠেকিয়ে যে অভিযান পরিচালনা করা হয়, তা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
হেফাজতের দাবি, ওই রাতে শত শত মানুষ নিহত হন, অধিকাংশেরই লাশ পাওয়া যায়নি। অনেক পরিবার এখনো সন্তান বা স্বজনের ফেরার অপেক্ষায় আছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ওই ঘটনার পর থেকে বারবার দাবি করে এসেছে যে, শাপলা চত্বরে ‘কেউ মারা যায়নি’। এমনকি সরকারের মন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাটিকে ‘রক্তপাতহীন ও নির্ভুল’ অভিযান বলে বর্ণনা করেছেন। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে।
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ তখনই বলেছিল, হেফাজতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে অন্তত ৬১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই ৫ মে অভিযানে প্রাণ হারান। কিন্তু সরকার ওই সংস্থার রিপোর্টকে ‘উস্কানিমূলক’ আখ্যা দিয়ে অধিকার-এর রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে এবং তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে।
ঘটনার এক দশক পার হয়ে গেলেও হেফাজত এতদিন কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি। সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ ছিল, নিহতদের নাম প্রকাশ না করায় দলটির নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে এবং পরিবারগুলো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এবার তালিকা প্রকাশ করায় কিছুটা স্বস্তি এলেও এখন প্রশ্ন উঠছে—এত বছর পরে কেন এই তথ্য প্রকাশ, এবং এখন কী ধরনের বিচার বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সম্ভব?
হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, তারা সময় নিয়েই তথ্যগুলো সংরক্ষণ ও যাচাই করেছেন। অনেক পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, আবার অনেকে ভয়ের কারণে কথা বলতে চাননি। তবে তারা ধাপে ধাপে এই তালিকা হালনাগাদ করবেন এবং জাতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ শহিদ তালিকা উপহার দেবেন।
প্রকাশিত প্রাথমিক তালিকায় দেখা যাচ্ছে, নিহতদের অধিকাংশই তরুণ ও যুবক। অনেকেই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিলেন। অনেকে ছিলেন দোকানি, দিনমজুর কিংবা সাধারণ কর্মজীবী মানুষ। একেক জনের পেছনে একেকটি বেদনাবিধুর গল্প। কেউ এসেছিলেন চট্টগ্রাম থেকে, কেউ নারায়ণগঞ্জ বা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। পরিবারগুলো অনেকেই বিশ্বাস করেছিল, হয়তো তাদের সন্তান ধরা পড়েছেন, ফিরে আসবেন। কিন্তু কেউ ফিরেনি।
হেফাজতে ইসলাম জানিয়েছে, তারা একাধিক মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে কাজ করে এ ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করবে। তালিকাটি এখন অনলাইনে সংরক্ষিত রয়েছে এবং যেকোনো ব্যক্তি যদি নতুন কোনো তথ্য বা সংশোধনী দিতে চান, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ফর্ম চালু করা হয়েছে।
সংগঠনটি মনে করছে, শাপলা চত্বরের গণহত্যার ঘটনার বিচার একদিন না একদিন হবেই। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ