
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৪০ কোটির বেশি রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসীর ধর্মীয় নেতৃত্বের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে খুব শিগগিরই। ২১ এপ্রিল মৃত্যু হয়েছে বর্তমান পোপ ফ্রান্সিসের, যিনি প্রায় এক দশক ধরে ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্বে ছিলেন। তার বিদায়ের পর এবার আসছে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। ভ্যাটিকানের গোপনীয় ভোটগ্রহণ প্রথা অনুযায়ী সিস্টিন চ্যাপেলের দরজা সিল করে শুরু হবে ভোটগ্রহণ, যা শুরু হবে ৭ মে’র পর থেকে। এর আগে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কার্ডিনালরা সম্মেলনে মিলিত হবেন, যেখানে তারা আলোচনা করবেন ভবিষ্যতের চার্চ কেমন হবে, এবং সেই রূপদর্শনে কে হবেন উপযুক্ত নেতা।
এই গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন পোপ, যাকে “প্রভুর প্রতিনিধিত্বকারী” হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং যার সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনায় চলে ক্যাথলিক চার্চের সার্বিক কর্মকাণ্ড। ৮০ বছরের কম বয়সী ১৩৫ জন কার্ডিনালই কেবল ভোট দিতে পারবেন, যদিও বাকি কার্ডিনালরাও আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন। এই নির্বাচন যতটা আধ্যাত্মিক, ততটাই রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক। নতুন পোপ নির্বাচনে ধর্মীয় আদর্শ, সংস্কারপন্থা বনাম রক্ষণশীলতা, আঞ্চলিক ভারসাম্য এমনকি ভাষাগত দক্ষতাও বড় ভূমিকা রাখে।
সম্ভাব্য পোপদের তালিকায় যারা রয়েছেন-
জঁ-মার্ক অ্যাভেলিন (ফ্রান্স)
৬৬ বছর বয়সী এই আর্চবিশপ মার্সেই শহর থেকে উঠে এসেছেন। তাকে ‘জন চতুর্বিংশ’ নামে অভিহিত করা হয়, কারণ তার চেহারার মিল রয়েছে পোপ জন ত্রয়োবিংশের সঙ্গে, যিনি বিশ শতকে সংস্কারপন্থি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিস একবার তাকে মজা করে ‘তার উত্তরসূরি’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন, যা তার পোপ নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনাকে আরও উজ্জ্বল করেছে।
লুইস আন্তোনিও ট্যাগল (ফিলিপাইন)
ম্যানিলার আর্চবিশপ ট্যাগল আগে থেকেই পোপ ফ্রান্সিসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এশিয়া থেকে প্রথম পোপ হওয়ার দৌড়ে তিনিই শীর্ষে রয়েছেন। ৬৭ বছর বয়সি ট্যাগল ক্যাথলিক গির্জার অভ্যন্তরীণ সমালোচক হিসেবে পরিচিত, বিশেষ করে বিবাহ বিচ্ছিন্ন ও সমকামীদের বিষয়ে গির্জার কঠোর অবস্থানকে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। যদিও তিনি গর্ভপাতের বিরোধিতা করেন, যা তাকে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
কার্ডিনাল পিটার এরদো (হাঙ্গেরি)
৭২ বছর বয়সী এই হাঙ্গেরিয়ান পাদ্রি পূর্বে পোপ ফ্রান্সিসের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি রক্ষণশীল হলেও ফ্রান্সিসের সংস্কার আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার ভাষাজ্ঞান (ইতালীয়, ফরাসি, জার্মান, রুশ, স্প্যানিশ) এবং ইউরোপীয় পরিচিতি তাকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। ইউরোপে নতুন করে পোপ বেছে নেওয়ার চর্চা জোরদার হলে তার সম্ভাবনা বাড়বে।
কার্ডিনাল মারিও গ্রেচ (মাল্টা)
৬৮ বছর বয়সী গ্রেচ ক্যাথলিক চার্চের 'সিনড অব বিশপস'–এর মহাসচিব হিসেবে কাজ করেছেন, যা তাকে ভ্যাটিকানে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রেখেছে। তিনি একসময় রক্ষণশীল হলেও, ফ্রান্সিসের সময়ে উদারনীতিকে গ্রহণ করেছেন। তাকে সংস্কারের ধারক হিসেবে দেখা হয়।
হুয়ান হোসে ওমেলা (স্পেন)
বার্সেলোনার এই আর্চবিশপ পোপ ফ্রান্সিসের অন্যতম পছন্দের পাদ্রি ছিলেন। জীবনে সরলতা, বিনয় ও সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী ওমেলার ভাবমূর্তি পোপ হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে লাতিন ভাষাভাষী দেশগুলোর মধ্যে তার জনপ্রিয়তা প্রবল।
পিয়েত্রো প্যারোলিন (ইতালি)
বর্তমান ভ্যাটিকান সেক্রেটারি অব স্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যারোলিন। ৭০ বছর বয়সী এই ইতালীয় ধর্মগুরুকে ‘ডেপুটি পোপ’ বলা হয় কারণ তিনি ভ্যাটিকানের পররাষ্ট্রনীতি দেখভাল করেন। তিনি বহু ভাষায় পারদর্শী এবং মধ্যপন্থী ধ্যানধারণার কারণে তাকে উদার ও রক্ষণশীল উভয় শিবিরের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা তাকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে আরও দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে।
জোসেফ টোবিন (যুক্তরাষ্ট্র)
৭২ বছর বয়সী এই আর্চবিশপ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সম্ভাব্য একমাত্র উল্লেখযোগ্য প্রার্থী। যদিও ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা থেকে কোনো পোপ নির্বাচিত হয়নি, তবুও পোপ ফ্রান্সিসের সময়ে তাকে কার্ডিনাল করা হয়, যা তার প্রতি পোপের আস্থার ইঙ্গিত দেয়। তিনি প্রগতিশীল এবং অভিবাসী নীতিতে সমর্থনকারী।
পিটার কোডও অ্যাপিয়াহ টার্কসন (ঘানা)
৭৬ বছর বয়সী ঘানার এই কার্ডিনাল সাব-সাহারা আফ্রিকা থেকে প্রথম পোপ হতে পারেন। ভ্যাটিকানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি এবং তার সংবেদনশীলতা ও কার্যক্ষমতা পোপ ফ্রান্সিসের সময়েও প্রশংসিত হয়েছে। তার অভিজ্ঞতা এবং বৈশ্বিক ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মাঝে বৈচিত্র্য আনার প্রতিশ্রুতি তাকে আলোচনায় রেখেছে।
মাত্তেও মারিয়া জুপ্পি (ইতালি)
বোলোগনার এই আর্চবিশপকে বলা হয় 'ইতালির বারগোগ্লিও' – প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের আসল নামের সূত্র ধরে এই নামকরণ। ১৯৭৮ সালের পর থেকে ইতালি থেকে আর কোনো পোপ নির্বাচিত হয়নি। তবে এবার মাত্তেওর সংস্কারপন্থী মনোভাব এবং ফ্রান্সিসের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত হওয়া তাকে শীর্ষ তালিকায় তুলে এনেছে।
নির্বাচন নিয়ে ভ্যাটিকানের প্রস্তুতি ও বৈশ্বিক আগ্রহ
ভ্যাটিকান এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত নতুন পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়া চালাতে। নির্বাচনের আগেই একাধিক বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে বর্তমান চ্যালেঞ্জ, ধর্মীয় নীতি, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে চার্চের সম্পর্ক, রাজনৈতিক চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, সমকামী অধিকার, এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো ইস্যুতে আলোচনা হবে। এই আলোচনার ভিত্তিতেই কার্ডিনালরা ঠিক করবেন, তারা কেমন ব্যক্তিকে পরবর্তী ধর্মগুরু হিসেবে দেখতে চান।
বিশ্বব্যাপী রোমান ক্যাথলিক বিশ্বাসীদের চোখ এখন সিস্টিন চ্যাপেলের দিকে। যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি হবেন ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতীক এবং চার্চের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশক। তিনি শুধু ধর্মীয় নন, বরং রাজনৈতিক, সামাজিক এবং কূটনৈতিক দিক থেকেও বিশাল প্রভাববিস্তারকারী হবেন। কে হবেন সেই ব্যক্তিত্ব, তা জানতে এখনও কিছুটা অপেক্ষা। তবে শীর্ষ প্রতিযোগীদের নাম ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে আলোচনায়।
তথ্যসূত্র: আলজাজিরা, রয়টার্স
বাংলাবার্তা/এমএইচ