
ছবি: সংগৃহীত
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় গত রোববার সন্ধ্যায় ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানী ঢাকায় ফেরার পথে, যখন একটি অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় তিনি যানজটে আটকা পড়া তার গাড়িবহরে ছিলেন। হঠাৎই কয়েকটি মোটরসাইকেলে আসা সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা তার গাড়ির ওপর পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালায়। এতে গাড়ির কাচ ভেঙে যায় এবং তিনি আহত হন। পরে পুলিশি প্রহরায় তাকে দ্রুত ঢাকায় পাঠানো হয়।
ঘটনার পরপরই গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) তৎপর হয়ে ওঠে। রাতভর গাজীপুর ও আশপাশের এলাকায় চালানো হয় সাঁড়াশি অভিযান। সন্দেহভাজন হিসেবে মোট ৫৪ জনকে আটক করা হয়েছে, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও যাচাই-বাছাই শেষে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
সোমবার সকালে জিএমপির সিটিএসবি অ্যান্ড প্রটেকশন বিভাগের চিফ ইনভেস্টিগেশন অফিসার (সিআইও) স্বাক্ষরিত এক আনুষ্ঠানিক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, হামলার প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের শনাক্তে প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা নজরদারি ব্যবহারের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান জানান, “হাসনাত আবদুল্লাহর ওপর হামলাকে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করে আমরা ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছি। হামলার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্তে সব ইউনিট সমন্বিতভাবে কাজ করছে। যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা তদন্তকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।”
ঘটনার পর এনসিপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এটি নিছক একটি বিচ্ছিন্ন হামলা নয়, বরং একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এনসিপি নেতারা দাবি করেছেন, এ ঘটনার পেছনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ জড়িত, যারা ভিন্নমতের রাজনীতিকদের দমন করতে এ ধরনের সশস্ত্র হামলার আশ্রয় নিচ্ছে।
হামলার প্রতিবাদে রোববার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে এনসিপির নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সোমবার এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। শিক্ষার্থীরা বলেন, “এটি শুধু একটি দলের নেতার ওপর হামলা নয়, এটি গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। রাষ্ট্র যদি সুষ্ঠু তদন্ত না করে, তাহলে এটিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত রাজনৈতিক সন্ত্রাস হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।”
এদিকে, এনসিপির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “যে সাহসিকতা ও ত্যাগের মাধ্যমে হাসনাত আবদুল্লাহ দীর্ঘদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তার ওপর এ ধরনের হামলা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হবে। হামলাকারীরা যতই শক্তিশালী হোক, আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা ও তার পরবর্তী উত্তেজনাকর পরিস্থিতি একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘাতের ইঙ্গিত বহন করছে। তারা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত রাখতেই হয়তো কোনো মহল এ ধরনের সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এনসিপি দলটি সম্প্রতি মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়ছে, যা শাসক দল আওয়ামী লীগের জন্য একধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটেই এমন সহিংস হামলা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে—নির্বাচনের আগে কি আবারও বাংলাদেশে সংঘাতমূলক রাজনীতির চক্রে ঢুকে পড়ছে দেশ?
পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত হামলার মোটিভ কিংবা অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘটনাটি যত দ্রুত সম্ভব স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত না করলে এটি ভবিষ্যতে আরও বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
এনসিপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই সরকারের প্রতি ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম জারি করা হয়েছে—হামলাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে দৃশ্যমান অগ্রগতি না হলে দলটি সারাদেশে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ