
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং সংশ্লিষ্ট সব খাতকে সমন্বয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘদিন ধরে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও বিক্রির ক্ষেত্রে চলমান অনিয়ম এবং প্রভাবশালী চক্রের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এই উদ্যোগকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গতকাল রোববার (৪ মে) রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এই নির্দেশনা প্রদান করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য, শিল্পখাত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের কর্মকর্তারা। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও স্বল্পআয়ের মানুষগুলো ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চামড়া বিক্রির এই অর্থ অনেক পরিবারে ঈদের পরের দিনগুলোতে সহায়তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অথচ কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এবং অব্যবস্থাপনার কারণে সেই প্রাপ্য আয়টুকু থেকেও তারা বঞ্চিত হন।”
ড. ইউনূস আরও বলেন, “এই চক্রভিত্তিক সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরই কোরবানির মৌসুমে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, দাম কমিয়ে দেয়, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ এবং প্রকৃত চামড়া সংগ্রাহকেরা। এই অবস্থা চলতে দেওয়া যাবে না। এবার আমরা অগ্রাধিকারভিত্তিতে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই। চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে সকল পক্ষকে নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগ প্রয়োজন।”
তিনি বলেন, কেবল চামড়ার দামই নয়, বরং পশু পরিবহন, হাট ব্যবস্থাপনা, পশুর প্রতি আচরণ, বর্জ্য অপসারণ এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ—এই সবগুলো বিষয়ে সুষ্ঠু ও মানবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। চামড়াশিল্প রক্ষায় পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতেও ড. ইউনূস জোর দেন। তিনি বলেন, “চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদিত ইটিপি (Effluent Treatment Plant) ব্যবহারে যেন কোনোরকম ছাড় দেওয়া না হয়। যারা নিয়ম মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এই নির্দেশনার আলোকে প্রধান উপদেষ্টা বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। কমিটিতে থাকবেন—
-
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার
-
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান
-
সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
-
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
-
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম
-
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া
-
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
-
প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী
-
বিডা ও বেজা নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন
-
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম
-
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ওবায়দুর রহমান
-
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধি
-
চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি
এই কমিটি কোরবানির আগে থেকেই কাজ শুরু করবে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ কার্যপরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়নের দিকে এগোবে। মূলত চামড়ার সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণন প্রক্রিয়া এবং সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট চিহ্নিত ও নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনাই এই কমিটির প্রধান লক্ষ্য।
বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, পশুর হাটে বা ট্রান্সপোর্টে পশুর সঙ্গে কোনরকম অমানবিক আচরণ বরদাশত করা হবে না। সংশ্লিষ্ট হাট ব্যবস্থাপনা কমিটিকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেওয়া হবে। তদুপরি, চামড়ার প্রক্রিয়াজাত এলাকায় পরিবেশদূষণ রোধে নিয়মিত মনিটরিং চালানো হবে এবং পরিবেশ সুরক্ষায় ইটিপি’র কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমসহ একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
এই উদ্যোগকে দেশের চামড়া খাতের ভবিষ্যতের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। আশা করা হচ্ছে, এবার ঈদে দরিদ্র মানুষরা তাদের কোরবানির পশুর চামড়ার প্রকৃত মূল্য পাবে, এবং দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট-নির্ভর ব্যবস্থার অবসান ঘটবে।
এই কমিটির কার্যক্রম ও অগ্রগতি নিয়ে নিয়মিতভাবে গণমাধ্যমকে অবহিত করা হবে বলেও জানানো হয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ