
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সাম্প্রতিক প্রাণঘাতী হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদ ভারতের বিরুদ্ধে এককভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটি রোববার (৪ মে) থেকে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের জন্য স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ—তিনটি রুটই একযোগে বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি তৃতীয় কোনো দেশের পণ্য পাকিস্তান ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশ করতেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে অবনতি শুরু হয়েছিল, এবার তা আবারও গভীর সংকটে পৌঁছাল।
পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে “জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বার্থ রক্ষার জন্য”। এতে বলা হয়, অবিলম্বে কার্যকর এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এখন থেকে:
পাকিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্যের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পাকিস্তানের ট্রানজিট রুট ব্যবহার করে ভারতে পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ
ভারতীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ পাকিস্তানের কোনো বন্দরে প্রবেশ করতে পারবে না
পাকিস্তানি পতাকাবাহী জাহাজও ভারতের কোনো বন্দরে ভিড়তে পারবে না
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগে ইস্যু করা ঋণপত্র (LC)-সম্পর্কিত পণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। অর্থাৎ যেসব পণ্যের জন্য চুক্তি ও আর্থিক প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলো রপ্তানি বা আমদানিতে বিশেষ অনুমতি থাকলে তা বিবেচনা করা হতে পারে।
এই সিদ্ধান্তের পেছনে সরাসরি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার পর্যটন শহর পেহেলগামে ভারতীয় পর্যটকদের ওপর সংঘটিত প্রাণঘাতী হামলা, যাতে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হন এবং আরও অনেকে আহত হন। ভারত এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনকে দায়ী করেছে এবং ইসলামাবাদকে এর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, তারা এ ঘটনায় জড়িত নয় এবং নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।
এই হামলার প্রেক্ষিতে শুধু বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাই নয়, সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীর সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তানও তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রেখেছে।
শনিবার রাতে পাকিস্তান প্রথমে এক ঘোষণায় জানায়, দেশটির বন্দরগুলোতে ভারতীয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ ভিড়তে পারবে না। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ভারতও পাকিস্তানি জাহাজের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। এতে করে দু’দেশের মধ্যে সামুদ্রিক বাণিজ্য কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ‘পোর্টস অ্যান্ড শিপিং উইং’ জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সমুদ্র-সংক্রান্ত নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যতিক্রমী কোনো আবেদন থাকলে তা পৃথকভাবে বিবেচনা করার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের এই পদক্ষেপ শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থায়ও প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো ভারতীয় পণ্য গ্রহণ করে মূলত পাকিস্তানের করাচি ও গ্বাদার বন্দরের ট্রানজিট ব্যবহার করে। নিষেধাজ্ঞার ফলে এই রুটগুলোও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এছাড়া, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগোলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ সেতু হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু এখন সেটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ভারতকে বিকল্প রুট যেমন চীন, বাংলাদেশ কিংবা ইরান ব্যবহার করতে হতে পারে, যা সময় ও ব্যয় উভয়ই বাড়াবে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক বহুদিন ধরেই টানাপোড়েনপূর্ণ। ২০১৬ সালের উরি হামলার পর ভারত ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ (MFN) স্ট্যাটাস পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামা হামলার পরেও ভারত-পাকিস্তান বাণিজ্য কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক চাপ এবং মানবিক বিবেচনায় দুই দেশের মধ্যে সীমিত পর্যায়ে পণ্য পরিবহন পুনরায় চালু হয়। এবার পেহেলগাম হামলার জেরে সেই ক্ষীণ সংযোগটিও ছিন্ন হয়ে গেল।
বর্তমান নিষেধাজ্ঞার ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও হিমায়িত হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এতে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা যেমন- সাফটা (SAFTA), সার্ক ট্রানজিট চুক্তিসহ অন্যান্য বহুপাক্ষিক উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, যদি দ্রুত কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে এই উত্তেজনা দু’দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ কিংবা বড় ধরনের কূটনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে গড়াতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ