
ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরের বাকি সময়, অর্থাৎ মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানি ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে সরকারের প্রয়োজন হবে প্রায় ১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১ হাজার ৮০ কোটি ডলার। এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ নিশ্চিত না হলে দেশের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও খাতসংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এলএনজি আমদানি, গ্যাস উত্তোলন, জ্বালানি আমদানি, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ বাবদ সরকারকে এই অর্থের সংস্থান করতে হবে। এপ্রিল পর্যন্ত আগের সব পাওনা পরিশোধ করা হলেও মে মাসের শুরুতেই দুই দিনের বকেয়া জমে গেছে, যার পরিমাণ প্রায় ৭০ কোটি ডলার।
সরকারি তথ্য অনুসারে, শুধু এলএনজি আমদানি ও দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের বিপরীতে বিল পরিশোধে ৩৩৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলার প্রয়োজন হবে মে-ডিসেম্বর মেয়াদে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) এই খাতে সরকার ১৬৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করছে এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেট থেকেও প্রতিমাসে ১-২টি কার্গো কিনছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এবং আন্তর্জাতিক ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) ঋণ পরিশোধে মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ৩৬০ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিপিসি মূলত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেল আমদানি করে থাকে এবং আইটিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে সেই আমদানির অর্থায়ন করে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে এই ঋণ পরিশোধ নিয়েও একাধিকবার জটিলতা তৈরি হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত খরচ ধরা হয়েছে ২৪১ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। এর বাইরে শুধুমাত্র ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশকে প্রায় ১২০ কোটি ডলার দিতে হবে। রয়টার্সের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আদানি পাওয়ারের বকেয়া আদায়ে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে এবং বর্তমানে তারা মাসিক বিলের চেয়ে বেশি অর্থ পাচ্ছে।
আদানি পাওয়ারের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা দিলিপ ঝা রয়টার্সকে বলেন, “বাংলাদেশে আমাদের পাওনা প্রায় ২০০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, চলতি মাসের বিলের পাশাপাশি বকেয়াও পরিশোধ হবে।”
আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যবহৃত কয়লার দামে অস্বচ্ছতা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রেজাউল করিম জানান, “আদানি যে পদ্ধতিতে কয়লার দাম নির্ধারণ করে, তাতে আমরা একমত নই। তারা আন্তর্জাতিক সূচক মূল্যের গড় ব্যবহার করে, যা তুলনামূলকভাবে বেশি পড়ে। অথচ অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমরা কয়লা আমদানির উৎস দেশের দামে বিল দিই। ফলে এই ব্যবধান থেকেই অর্থ পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়।”
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, পায়রা ও রামপাল কেন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে কয়লা দামে ছাড়ের সুযোগ থাকলেও, আদানির ক্ষেত্রে তা নেই। পায়রা প্রকল্পে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা কেনা হয় এবং সেখানে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যায়। ফলে আদানির কেন্দ্রের তুলনায় এই দুই প্রকল্প অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, “আমাদের জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশীয় অনুসন্ধান কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। বিদ্যমান রিজার্ভ পরিস্থিতিতে আমদানি কমিয়ে অভ্যন্তরীণ বিকল্প উৎসকে গুরুত্ব না দিলে সংকট আরও গভীর হবে।”
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বকেয়া ও আগাম ব্যয় মেটাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ঋণ ও অনুদান চুক্তির বিষয়েও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে এই অর্থ সংস্থান না হলে এলএনজি কার্গো ও তেল আমদানিতে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মেগা ব্যয়ের এই চিত্র প্রমাণ করে যে, অর্থনৈতিক চাপের কারণে সরকারকে প্রতিমাসে কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। আমদানি নির্ভরতা, আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা এবং অর্থ সংকট একত্রে চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর সমাধান হতে পারে নিজস্ব মজুত অনুসন্ধান ও স্থানীয় জ্বালানি উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো। তা না হলে এই খাতে টেকসইতা অর্জন কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ