
ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) রাজস্ব আদায়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি মোট ৯০ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করেছে—যা দেশের ইতিহাসে এক প্রান্তিকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের রেকর্ড। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এই আদায় ১৫ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বা ২০.২১ শতাংশ বেশি।
যদিও এই প্রবৃদ্ধি এনবিআরের জন্য একটি বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তবুও রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সংস্থাটি এখনও পিছিয়ে রয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, রাজস্ব প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সকালে রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত তথ্য গণমাধ্যমে জানাতে গিয়ে এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল আমিন শেখ বলেন, “২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কর আদায়ের প্রতিটি খাতেই রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আয়কর, মূসক (ভ্যাট) ও আমদানি–রপ্তানি—সব খাতেই কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কাজ করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা করদাতাদের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি কর ফাঁকি প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি চালিয়েছি। অনলাইনে কর পরিশোধের হার বেড়েছে, করদাতাদের পরিপালন বেড়েছে। ফলে এই তিন মাসে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি হয়েছে।”
আল আমিন শেখ আরও উল্লেখ করেন, করের আওতা বাড়ানো, নতুন করদাতা নিবন্ধন, বড় করফাঁকিবাজদের শনাক্তকরণ ও পুনরুদ্ধার অভিযানের ফলেই এই রেকর্ড রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়েছে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৭৫ হাজার ৫৫৪ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছর ২০২৩–২৪ সালে আদায় হয়েছিল ৭৬ হাজার ৬৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, আর ২০২২–২৩ অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৬৮ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, গত তিন বছরে প্রান্তিকভিত্তিক রাজস্ব আদায়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তবে এবারের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি।
এনবিআরের খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সর্বাধিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মূসক (ভ্যাট) খাতে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯.৭৪ শতাংশ—যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে স্থানীয় পর্যায়ের ভ্যাট খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে আদায় ছিল ২৬ হাজার ৮৩৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ফলে এই খাতেই এক প্রান্তিকে ৭ হাজার ৭৮০ কোটি ৫১ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব এসেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাট খাতে এই প্রবৃদ্ধি এসেছে মূলত রিটেইল ও সার্ভিস সেক্টরে ইলেকট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (EFD) ব্যবহারের সম্প্রসারণ, অনলাইন ভ্যাট পরিশোধের বৃদ্ধি এবং কর পরিপালন সংস্কৃতির উন্নতির কারণে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি এসেছে আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এই খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা বেশি। প্রবৃদ্ধির হার ১৮.২৬ শতাংশ।
গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরের একই সময়ে এই খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২৪ হাজার ৮০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, বড় করদাতা ইউনিট (LTU) থেকে কর আদায় বেড়েছে, করপোরেট আয়কর পরিশোধে শৃঙ্খলা এসেছে এবং ব্যক্তি পর্যায়ের আয়কর দাখিলকারীর সংখ্যা প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া বিদেশগামী যাত্রীদের ওপর আরোপিত ভ্রমণ কর থেকেও রাজস্ব বাড়ছে, বিশেষ করে বিমান ভ্রমণ বৃদ্ধি এবং টিকিট বিক্রির ওপর স্বচ্ছ কর সংগ্রহ নিশ্চিত করার কারণে।
আমদানি ও রপ্তানি খাতের শুল্কেও সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এই খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ২৪ হাজার ৬২৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকার তুলনায় ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা বেশি। প্রবৃদ্ধির হার ১১.৭৪ শতাংশ।
রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, আমদানি পণ্যের মূল্যায়ন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, বন্দর পর্যায়ে ডিজিটাল স্ক্যানিং ও মনিটরিং, এবং অবৈধ পণ্য আমদানি প্রতিরোধের কারণে এ খাতে রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
তবে রপ্তানি প্রণোদনা ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ নীতির কারণে এই খাতের প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে সীমিত থেকেছে।
চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, আর বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসবে অন্যান্য উৎস থেকে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রথম প্রান্তিকের এই রেকর্ড প্রবৃদ্ধি যদি বছরের বাকি অংশেও ধরে রাখা যায়, তাহলে অর্থবছরের শেষ নাগাদ রাজস্ব ঘাটতি অনেকাংশে কমে আসবে। তবে তাঁরা সতর্ক করে বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, বাণিজ্য প্রবাহের ধারাবাহিকতা এবং কর সংস্কার কার্যক্রমের গতি—এই তিনটি বিষয়ই আগামী মাসগুলোর রাজস্ব পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করবে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, “রাজস্ব আদায় বেড়েছে, কিন্তু করজিডিপি অনুপাত এখনো খুব কম। রাজস্ব আয় বাড়াতে হলে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, ন্যায্য করনীতি, কর সংস্কার ও জনগণের আস্থা বাড়ানোর কাজও সমান জরুরি।”
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী প্রান্তিক থেকে ডিজিটাল ট্যাক্স ইনফরমেশন সিস্টেম (DTIS) চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে প্রতিটি খাতের রাজস্ব আদায় রিয়েল টাইমে ট্র্যাক করা যাবে এবং করদাতার তথ্য বিশ্লেষণ সহজ হবে।
এছাড়া, বড় করদাতা ইউনিট (LTU) ও জেলা পর্যায়ের অফিসে স্বয়ংক্রিয় নিরীক্ষা পদ্ধতি চালু করারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে কর ফাঁকি প্রতিরোধ আরও কার্যকর হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।
প্রথম প্রান্তিকে এমন রেকর্ড সাফল্য এনবিআরের কর্মকর্তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করবে এই ধারা কতটা টেকসইভাবে বজায় রাখা যায় তার ওপর। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি যদি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে সুষমভাবে মিলে যায়—তবেই তা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে রূপ নেবে।
বাংলাবার্তা/এসজে