
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে জাতীয় দলের উদীয়মান ব্যাটার তাওহীদ হৃদয়ের শৃঙ্খলাজনিত শাস্তি ও তা ঘিরে বিসিবির নীতিনির্ধারকদের দোদুল্যমানতা। মাঠে আম্পায়ারের সঙ্গে অসদাচরণ এবং গণমাধ্যমে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গৃহীত শাস্তি ও সেটি নিয়ে ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে তুমুল বিতর্ক, অসন্তোষ, এমনকি ক্রিকেটারদের প্রতিবাদ পর্যন্ত।
এই পুরো পর্ব এখন ক্রিকেট অঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠেছে ‘হৃদয় নাটক’ নামে—যার শেষ পরিণতিটিও রয়ে গেছে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।
কীভাবে শুরু হলো শাস্তির বিষয়টি?
ঘটনার সূত্রপাত হয় ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ (ডিপিএল) চলাকালীন এক ম্যাচে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়ে আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়া জানান হৃদয়। শুধু তাই নয়, ম্যাচ শেষে গণমাধ্যমের সামনে গিয়ে সংশ্লিষ্ট আম্পায়ার ও বোর্ডের কার্যক্রম নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
এই ঘটনায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) প্রথম দফায় হৃদয়কে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেয়। শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বোর্ড জানায়, জাতীয় দলে খেলা একজন ক্রিকেটারের কাছ থেকে এমন আচরণ অগ্রহণযোগ্য এবং সেটি উদাহরণ স্থাপনের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দাবী করে।
হঠাৎ শাস্তি কমানো ও সমালোচনার ঝড়
তবে বিসিবির এই সিদ্ধান্তের পর মোহামেডান ক্লাব কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করে। বিস্ময়করভাবে, সেই আপিল গৃহীত হয় এমন এক নিয়মের আওতায় যা আগে কখনো ব্যবহার হয়নি বা যা তৎক্ষণাৎ প্রয়োগযোগ্য কি না, তা নিয়েও ছিল সংশয়। এরই মধ্যে বিসিবি নিয়মে ‘ছাড়’ দিয়ে হৃদয়ের নিষেধাজ্ঞা এক ম্যাচে কমিয়ে আনে।
এই পরিবর্তনেই শুরু হয় বিতর্কের বিস্তার। ক্রিকেট অঙ্গনের বিশ্লেষক থেকে শুরু করে ভক্তরা বিসিবির এমন নমনীয়তায় বিস্মিত হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। উঠতে থাকে পক্ষপাতিত্ব ও সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ। কেউ কেউ এটিকে দেখেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর প্রভাবের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ হিসেবে।
পুনরায় দুই ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা
জনমতের চাপ ও বোর্ডের অভ্যন্তরে চাপের মুখে পড়ে বিসিবি আবারও পেছনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। তারা জানিয়ে দেয়, আগের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত—হৃদয়ের দুই ম্যাচ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে এবং তিনি ডিপিএলের পরবর্তী ম্যাচে মাঠে নামতে পারবেন না।
এই ঘোষণায় মোহামেডান শিবিরে আবারও অস্বস্তি দেখা দেয়। এমনকি অন্যান্য খেলোয়াড়রাও বিসিবির এ ধরনের নীতিহীন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ক্রিকেটারদের বৈঠক, তামিমের ভূমিকা
অবশেষে ক্রিকেটারদের একটি প্রতিনিধি দল বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন-এর সঙ্গে বৈঠকে বসে। সেখানে মোহামেডানের অধিনায়ক তামিম ইকবালসহ সিনিয়র ক্রিকেটাররা দৃঢ় অবস্থান নেন। তারা বোর্ড সভাপতির সামনে স্পষ্ট করে বলেন, হৃদয়ের মতো তরুণ খেলোয়াড়কে বোর্ডের এমন দ্বিচারিতা করে ভেঙে ফেলা ঠিক নয়। শাস্তি হওয়া উচিত, তবে সেটি হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক এবং পূর্বঘোষিত কাঠামোর ভিত্তিতে।
তামিমের নেতৃত্বে এই চাপ প্রয়োগের ফলেই নতুন সিদ্ধান্তে আসে বিসিবি।
এক বছরের জন্য শাস্তি স্থগিত
সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, তাওহীদ হৃদয়ের বাকি থাকা এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা এক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, আগামী এক বছরে যদি হৃদয় আবার কোনো শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে পূর্ববর্তী এই স্থগিত নিষেধাজ্ঞাও তৎক্ষণাৎ কার্যকর হবে।
এতে আপাতত মাঠে ফিরতে পারছেন হৃদয়, কিন্তু তার মাথার উপর ঝুলছে এক ধরনের ‘ড্যামোক্লিসের তলোয়ার’।
বিসিবির ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ
এই পুরো প্রক্রিয়াটি বিসিবির নীতি ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়েই বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। খেলোয়াড়দের শাস্তি দিতে গিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত পাল্টানো এবং অভ্যন্তরীণ চাপ-প্রভাবকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগের মুখে এখন বোর্ডকে বেশ অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠছে—বোর্ড কি ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ আচরণ নিশ্চিত করতে পারবে? না কি প্রভাবশালী ক্লাব ও খেলোয়াড়দের দাবির মুখে নিয়ম পাল্টানোই হয়ে উঠবে নতুন রীতি?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে। তবে একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার হচ্ছে, তাওহীদ হৃদয়ের শাস্তি নিয়ে এই নাটক শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, পুরো দেশের ক্রিকেট প্রশাসনের নৈতিক কাঠামো নিয়েই আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ