
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সিদ্ধান্তের পরপরই সরকার সতর্ক করে বলেছে—নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ এবং তাদের অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এক মধ্যরাতের ফেসবুক পোস্টে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
শনিবার রাত ৮টায় রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দীর্ঘ বৈঠক শেষে রাত ১১টার দিকে উপদেষ্টারা এক যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত হয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমকে জানান।
এই বৈঠকে গৃহীত মূল তিনটি সিদ্ধান্ত হলো:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রম (সরাসরি ও অনলাইন—উভয়ই) নিষিদ্ধ ঘোষণা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী এনে ট্রাইব্যুনালকে রাজনৈতিক দল, এর অঙ্গ সংগঠন ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্ণ অধিকার প্রদান।
জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঘোষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত করে জাতির সামনে উপস্থাপন।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী ইতোমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হয়েছে। সংশোধনী অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল এখন রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গ সংগঠন এবং সমর্থক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক রায় দিতে পারবে।
তিনি আরও জানান, এই নিষেধাজ্ঞা কেবল রাজনৈতিক কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে দলের অনলাইন কার্যক্রম, সামাজিক মাধ্যমে প্রচার, সমর্থক গোষ্ঠীর গণমাধ্যম কার্যক্রম ও অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত সকল ধরনের উদ্যোগকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই সিদ্ধান্তের প্রধান উদ্দেশ্য হলো—দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথে কোন ধরনের বাধা আসা প্রতিহত করা, এবং আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
এ প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল বলেন, “দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শিগগিরই একটি পরিপত্র জারি করা হবে। আইনগত দিক থেকে কোন দুর্বলতা যেন না থাকে, সে জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।”
শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দিয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ অভিযোগ করেন, নিষিদ্ধ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগপন্থী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো সারাদেশে ‘সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা’ ঘটানোর ষড়যন্ত্র করছে।
তিনি বলেন, “বিচারিক প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞাই অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী সমাধান। সেই লক্ষ্যেই আইসিটি আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে। আমাদের কাছে আসা তথ্যে জানা গেছে, নিষিদ্ধ হওয়ার পর গণহত্যাকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতার পরিকল্পনা করছে। জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি—সতর্ক ও সজাগ থাকুন।”
আসিফ মাহমুদের এই বার্তা অনেকে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করছেন, যা থেকে স্পষ্ট যে সরকার বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তা সংকট হিসেবে বিবেচনা করছে।
বৈঠকে আলোচিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার যে রাজনৈতিক রূপরেখার ঘোষণা দেয়, সেটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত করে উপস্থাপনের জন্য ৩০ কার্যদিবস সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো, নির্বাচনকালীন নীতিমালা, বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সুরক্ষার রূপরেখা স্পষ্ট করা হবে।
আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সরকার যেখানে বিষয়টিকে গণহত্যার বিচার ও নিরাপত্তার প্রশ্ন বলে উপস্থাপন করছে, সেখানে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবার, যখন একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় এসে নিষিদ্ধ হলো। যদিও আওয়ামী লীগ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা চরম সাংগঠনিক সংকটে পড়েছেন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে বর্তমান বাস্তবতা। যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের মাঝে ন্যায়বিচার, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এখন জাতির সামনে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগপন্থীদের কার্যকলাপ ও অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা—এই দুইয়ের পারস্পরিক গতিপথ নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনৈতিক চিত্র।
বাংলাবার্তা/এমএইচ