
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকটে বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে নতুন করে আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাতের কারণে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নতুন করে বাস্তুচ্যুত হওয়া ১ লাখ ১৩ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
জাতিসংঘের এই অনুরোধ এসেছে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার ও বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যকার চলমান লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে, যেখানে পরিস্থিতি ভয়াবহ রকমের মানবিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের অধীন রোহিঙ্গাদের সহায়তায় গঠিত সংস্থা রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপ্যাট্রিয়েশন কমিশন (RRRC)–এর কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান তুরস্কভিত্তিক রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, “গত সপ্তাহে আমাদের কাছে ইউএনএইচসিআর একটি চিঠি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নতুন প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।”
নতুন করে আসা এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছে। কেউ কেউ স্কুল বা মসজিদে আশ্রয় নিয়েছে, যা স্থানীয় অবকাঠামোর উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।
জাতীয় দৈনিকের বরাতে আনাদোলু এজেন্সি জানিয়েছে, এই নতুন রোহিঙ্গারা ২৯ হাজার ৬০৭টি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কেবল গত সপ্তাহেই বাংলাদেশে এসেছে ১ হাজার ৪৪৮টি পরিবার। এই পরিবারগুলোর বেশিরভাগই রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা এবং নাফ নদী পেরিয়ে জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে বাংলাদেশে ঢুকেছে।
মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা এখনো জাতিসংঘের অনুরোধে কোনো আনুষ্ঠানিক উত্তর দিইনি। কারণ আমাদের আশঙ্কা, এভাবে যদি নতুন রোহিঙ্গাদের অব্যাহতভাবে আশ্রয় দিতে থাকি, তাহলে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে যাবে।”
বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সম্মুখীন। ওই বছরের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) একযোগে কয়েকটি পুলিশ স্টেশন ও সেনাঘাঁটিতে হামলা চালায়। তার পরপরই সেনাবাহিনী শুরু করে ব্যাপক দমন-পীড়ন।
সেনাদের বর্বর নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, লুটপাট এবং বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার মতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের ভয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
বাংলাদেশের সরকার শুরুতে মানবিক বিবেচনায় কক্সবাজারের টেকনাফের কুতুপালংয়ে তাদের জন্য বিশাল শরণার্থী শিবির নির্মাণ করে। পরে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় ও শিক্ষাসুবিধা চালু হয়। বর্তমানে কুতুপালংসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাস করছেন প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারে বর্তমানে রীতিমতো একটি গৃহযুদ্ধ চলছে। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি–র মধ্যে সংঘাত চরমে পৌঁছেছে।
বর্তমানে পুরো রাখাইন রাজ্যের প্রায় সব এলাকাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, শুধুমাত্র রাজধানী সিতওয়ে ছাড়া। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকাও বিদ্রোহীদের দখলে রয়েছে। এতে করে সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাহীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা তাদের নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধ্য করছে।
ইউএনএইচসিআর-এর অনুরোধের মাধ্যমে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মহল নতুন এই বাস্তুচ্যুতি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এখন তারা চায় বাংলাদেশ আবারও মানবিক দায়িত্ব পালন করুক।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রতিবার মানবিকতার ভিত্তিতে শরণার্থী আশ্রয় দিলে আন্তর্জাতিকভাবে ‘স্থায়ী শরণার্থী’ হিসেবে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার একটি অঘোষিত স্বীকৃতি তৈরি হয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে তাদের প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টাকে অকার্যকর করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ একদিকে আন্তর্জাতিক মানবিকতার আহ্বানে সাড়া দিতে চায়, অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিয়েও চিন্তিত।
দেশটি ইতোমধ্যে ১৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ভার বহন করছে, যার জন্য বছরে শত কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন। নতুন করে ১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় দেওয়ার অর্থ হচ্ছে–এই চাপ আরও বহুগুণে বেড়ে যাওয়া।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নতুন শরণার্থীদের ভার ভাগ না নেয় এবং প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের উপর চাপ না বাড়ায়, তাহলে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী শরণার্থী সংকট তৈরি হতে পারে, যা কেবল মানবিক নয়, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ