
বাংলাবার্তা
থানা হেফাজতে দুদকের সাবেক ডিডি শহীদুল্যাহ এর মৃত্যুর নেপথ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতির আশ্রয়ে ভূয়া ওয়ারেন্ট তামিলের ঘটনায় দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া জন্য কমিশন বরাবর আবেদন করে। এরপর অভিযোগটি কমিশন সভায় নথিজাত করা হয়েছে।
অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, গত ৪ অক্টোবর রাত আনুমানিক ১১:৪০ মিনিটের দিকে সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ(সাবেক উপ-পরিচালক, দূর্নীতি দমন কমিশন)-কে চাঁন্দগাও থানার দুইজন পুলিশ বাসার সামনে থেকে ধরে নিয়ে যান থানায় নেওয়ার ১৫-২০ মিনিট পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
যদিও এর আগে তার বুকে ব্যাথা দেখা দিলে প্রেসক্রাইবড স্প্রে তাকে প্রয়োগের সুযোগ দেয়া হয় নাই এমনকি থানার সকল গেটই বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো।
এই ঘটনা বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা ও মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় এবং তার মৃত্যুকে অস্বাভাবিক উল্লেখ বলে তুলে ধরা হয়। শুধু তাই নয়, উক্ত মামলার বাদী রনি আক্তার তার করা মামলা উদ্দেশ্যমূলক ছিলো বলে প্রত্যাহার করেন।
এরআগে গত ১৬ অক্টোবর তার স্ত্রী ফৌজিয়া আফরোজ চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলাটিতে চাঁন্দগাও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), একইথানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) ও দুই সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) এবং আরও পাঁচজনকে আসামি করাহয়। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে চাঁন্দগাও থানায় এফআইআর রুজু করে পিবিআইকে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। যে মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশ হেফাজতে শহীদুল্লাহ মারা গেছেন সেটিও ৩০ অক্টোবর প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আরও জানা যায়, একই সঙ্গে ঐ দিন মিথ্যা মামলা দায়ের ও প্রতিপক্ষকে হয়রানির অভিযোগে বাদী তানিয়া আক্তারসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এদিকে গত ৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রতিদিন পত্রিকায় ”চট্টগ্রামে থানায় মারা যাওয়া দুদকের ডিডিকে ফাঁসাতে ’সমনগায়েব’ আদালতের পেশকারের ওয়ারেন্ট বাণিজ্য” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এই সংবাদটি আমলেগ্রহণ করে কমিশনে গত ৮ অক্টোবর দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের যৌথস্বাক্ষরে কমিশন বরাবর একটি আবেদন করা হয়।
এদিকে কোন সরকারি কর্মচারী কর্তৃক প্রতারণা ও অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার পূর্বক জাল- জালিয়াতির মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের অনুসন্ধান/তদন্ত দুদকের শিডিউলভূক্ত অপরাধ। অন্য কোন সংস্থা কর্তৃক তা তদন্ত করার সুযোগ নাই।
আলোচিত ঐ হত্যা মামলাটি নিয়ে দুদকের সাবেক ডিজি মইদুল ইসলাম দৈনিক দেশ রুপান্তর পত্রিকায় তিন পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন ”একটি ওয়ারেন্ট একটি মৃত্যু কয়েব হাত” লিখেন।
এদিকে মারা যাওয়া দুদকের সাবেক ডিডি শহীদুল্যাহর পরিবার বলছে, ওয়ারেন্ট বাণিজ্য, সমন গায়েব ও কোর্ট কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহার সংঘটিত হয়েছে। নন-ওয়ারেন্টভূক্ত এই মামলায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট যদি ওয়ারেন্ট না দিতেন,তাহলে হয়তবা শহীদুল্লাহর এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যু হতোনা। অপরদিকে জানা যায়, দুদকের একটি সেল আছে যেখানে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদসমূহকে ধর্তব্য আনা হয়।
যদিও দুদকের সেই শাখাটি কতটুকু প্রাণবন্ত, তা বুঝা যায় মহামান্য হাইকোর্ট হতে সুয়ে মেটো হয়ে তদন্তের নির্দেশ কিংবা ব্যারিস্টার সুমনের একের পর এক অভিযোগ দুদকে নিয়ে আসার ফলে। এখানে সাম্প্রতিক সেল শাখাটি নীরব।
অপরদিকে অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি দুদক কর্তৃক অনুসন্ধানযোগ্য মর্মেই ডুসা কর্তৃক দুদক চেয়ারম্যান বরাবর একটি আবেদন জমা দেয় গত ৭ নভেম্বর।
ঐদিন সকাল ১১ টায় কমিশন সভায় আলোচ্য সূচি নং: নথি নং ০০.০১.০০০০.৫০৩.২৬.৫২৮.২৩ সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রাম থানায় মারা যাওয়া দুদকের সাবেক ডিডিকে ফাঁসাতে সমন গায়েব, আদালতের পেশকারের ওয়ারেন্ট বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে আলোচনা ও সিন্ধান্ত গ্রহণ হয়।
সেই আলোচনা সূত্রে জানা যায়, দুদকের সাবেক ডিডি মরহুম ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে ফাঁসাতে তার বিরুদ্ধে গৃহবধু রনি আক্তার তানিয়াকে বাদী সাজিয়ে চাঁদাবাজি, আইনজীবী, কোর্ট কর্মকর্তা ও বিপথগামী কতিপয় পুলিশ সদস্যের সিন্ডিকেট করে মিথ্যা, মনগড়া, ভিত্তিহীন পিটিশন মামলা দায়ের করা হয়।
পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের মাধ্যমে সমন গায়েব ওহ গোপন করে এবং তড়িঘড়ি করে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে মরহুম ছৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ বহু মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে।
সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ ও দুর্নীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানা যায়।”চট্টগ্রামের থানায় মারা যাওয়া দুদকের ডিডিকে ফাঁসাতে সমন গায়েব আদালতের পেশকারের ওয়ারেন্ট বাণিজ্য” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে ডুসার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা এর পক্ষ হতে বিষয়টি কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধানের জন্য আবেদন করা হয়।
তবে দুদকের সেই সভায় বিস্তারিত আলোচনান্তে আলোচ্য অভিযোগটি নথিজাত করার বিষয়ে কমিশন একমত পোষণ করে। তবে গৃহীত সিন্ধান্তের কলামে উল্লেখ আছে, আলোচনা মোতাবেক অভিযোগটি নথিজাত করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে দুদকের সাবেক ডিজি মইদুল ইসলাম বাংলাবার্তাকে বলেন, ডুসা যে আবেদনটি করেছিলো সেই আবেদন করার আগেই দুদক নিজে মামলাটি আমলে নিতে পারতো। কারণ এখানে চাঁদাবাজি ও জমি নিয়ে সমস্যা। চাঁদা না দেওয়ায় মিথ্যা মামলা করা হলো। মামলা ছাড়াও আদালতের পেশকার ও ম্যাজিস্ট্রেট যে ব্যবস্থা নিলেন সেটাও সঠিক নয়। অপরদিকে ওয়ারেন্ট নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। সম্পন্ন বেআইনীভাবে ওয়ারেন্ট করা হলো। ৩২৬ ও ৫০৬ ধারাটি জামিন যোগ্য হলেও ম্যাজিস্ট্রেট জামিন বিহীন ওয়ারেন্ট কিভাবে দিলেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি কোন কর্মকর্তা বেআইনীভাবে কিছু করলে বা কারও ক্ষতি করলে সেটা দুদকের ধারায় পড়ে যায়। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ৫/২ এবং দন্ড বিধির ১৬৬ এ কমিশন এই মামলাটি আমলে নিতে পারে। কারণ এখানে দুর্নীতির সাথে সাথে একজন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আদালতকে ব্যবহার এবং জালিয়াতি করে মামলা এখানে দুর্নীতি হয়েছে। দুদকের কর্তা ব্যক্তিরা কেন বিষয়টি আমলে নিলেন না সেটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। দুদক শুধু চুনোপুঁটি ধরে কিন্তু এখানে কোন রাঘববোয়াল আছে যার কারণে দুদক বিষয়টি আমলে নিলো না সেটি আমার বোধগম্য নয়।
তবে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বাংলাবার্তাকে বলেছেন, দুদকের নিজস্ব কর্মকর্তার মৃত্যুতে কমিশনের এই অবস্থান অনেককেই হতবাক করেছে।
আলোচিত দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিনের অপসারণকে কেন্দ্র করেই ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ডুসা গঠিত হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠার পর হতে অদ্যা বদি অ্যাসোসিয়েশন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রেসরিলিজ, সংশ্লিষ্টদের ডায়েরি প্রদান, জাতীয় দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন ও নিন্দা প্রস্তাবের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ এই অ্যাসোসিয়েশন এর কার্যক্রম।
অথচ, মহাপরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপদেষ্টা পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও ডুসার দাখিলকৃত অভিযোগ নথি জাতের মাধ্যমেই কমিশনের ম্যাসেজ ক্লিয়ার। যদিও ডুসা এতদবিষয়ে অদ্যাবধি নীরব রয়েছেন।
তবে এ বিষয়ে শহীদুল্লাহ’র ছেলে ক্যাপ্টেন নাফিস বাংলাবার্তাকে বলেন, বাবার প্রতিষ্ঠান থেকেই আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করি। আশা করছি, মাননীয় কমিশন বিষয়টি পুর্ন: বিবেচনায় এনে জাল-জালিয়াতির বিষয়টির রহস্য উন্মোচিত করবে।