
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে রাজধানীর শীর্ষ প্রশাসনিক এলাকা ‘যমুনা’ ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে বৃহস্পতিবার (৮ মে) দিবাগত রাত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনার সামনে রাত ১০টার পর থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ এবং অবস্থান কর্মসূচি। মূল আয়োজনের নেতৃত্বে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), তবে এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সেখানে একে একে হাজির হতে থাকেন বিভিন্ন ছাত্র, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা, যারা সবাই জুলাই বিপ্লবের অংশ হিসেবে পরিচিত।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মধ্যরাতের পর আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক আবেগঘন বক্তব্যে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। কিন্তু আমাদের আবারও সেই ঘৃণ্য দলটির নিষিদ্ধের দাবিতে রাজপথে নামতে হলো। আমাদের ঘরে ফেরা হয়নি, আমরা আজ রাতে রাজপথে শুয়ে, বসে, অবস্থান করেই গণতন্ত্রের শুদ্ধি আনব।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ এই দেশের গণতন্ত্র, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন—সব কিছুই বিকৃত করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব সাহসী পদক্ষেপ আমরা দেখেছি, তার পূর্ণতা হবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে।”
তার বক্তব্য চলাকালে একের পর এক স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে যমুনার সামনের এলাকা। ‘ব্যান ব্যান আওয়ামী লীগ’, ‘আমার সোনার বাংলায়, আওয়ামী লীগের ঠাঁই নাই’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’—এইসব শ্লোগানে ছাত্রনেতারা, তরুণ কর্মী এবং সাধারণ জনগণ একাত্মতা প্রকাশ করেন।
এ কর্মসূচির সূচনা হয় বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে, যখন এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ একটি ভিডিও বার্তায় ‘যমুনার সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। তার আহ্বানেই প্রথমে শতাধিক কর্মী জড়ো হতে থাকেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ছাত্রনেতা ও জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য।
শুরু থেকেই যমুনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ব্যারিকেড দেওয়া হলেও বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিতে দিতে মূল প্রবেশপথের খুব কাছে এসে অবস্থান নেন। পরে পুলিশের সঙ্গে কোনো রকম সংঘর্ষ ছাড়াই আন্দোলনকারীরা বসে পড়েন এবং ব্যানার-প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন।
এই অবস্থান কর্মসূচিতে একাত্মতা প্রকাশ করে মাঠে নামে আরও কয়েকটি সংগঠন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, জুলাই ঐক্য পরিষদ, ইনকিলাব মঞ্চ, আপ বাংলাদেশ, ইনকিলাব উইমেন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কসহ একাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম এ কর্মসূচিতে সরাসরি যোগ দেয়।
তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি রাষ্ট্রীয় দানব, যাকে নিষ্ক্রিয় না করলে এই দেশ কখনও মুক্ত গণতন্ত্রে ফিরতে পারবে না। আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের “গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, দখল-চাঁদাবাজি, সংবিধানবিরোধী আইন প্রণয়ন, নির্বাচন কারচুপি এবং জবাবদিহিতাহীনতার” বিস্তারিত তালিকা তুলে ধরেন এবং এসব অপরাধের দায়ে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এই আন্দোলন এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণই রয়েছে। আন্দোলনকারীরা জাতীয় পতাকা, ব্যানার, পোস্টার ও প্রতীকী কফিন নিয়ে যমুনার সামনে অবস্থান করছেন। তাদের দাবি, আওয়ামী লীগ একটি "মৃত রাজনৈতিক শক্তি", যার গণবিচ্ছিন্নতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন কেবল রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এর কবর রচনা করা বাকি।
তারা অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এই অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। নাহিদ ইসলাম বলেন, “এই আন্দোলন প্রতিদিন বৃহত্তর হবে। এটি একটি গণআন্দোলনের সূচনা, যেখানে রাজনীতি ও জনতার শক্তি মিলেমিশে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করবে।”
এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ অবস্থান কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে সরকারের একাধিক উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের’ বিষয়টি এখন আইনি যাচাই-বাছাইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা শিগগিরই আসতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই আন্দোলনের ধারা বহাল থাকে এবং সরকারি ঘোষণার সঙ্গে একত্রিত হয়, তাহলে আগামী কয়েক সপ্তাহ বাংলাদেশ রাজনীতির ইতিহাসে এক ভয়াবহ পালাবদলের সূচক হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ