
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ক্যাথলিক খ্রিস্টানের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত সৃষ্টি হলো—রোমান ক্যাথলিক চার্চের নতুন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্ডিনাল রবার্ট প্রিভোস্ট। নির্বাচনের পর তিনি পোপ হিসেবে নাম গ্রহণ করেছেন লিও চতুর্দশ। এ-ই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো ব্যক্তি ক্যাথলিক চার্চের পোপ নির্বাচিত হলেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন এবং পরবর্তীতে এটি আন্তর্জাতিক মহলেও ব্যাপক আলোড়ন তোলে।
পোপ নির্বাচনের ঐতিহ্যবাহী প্রক্রিয়া অনুসারে ভ্যাটিকান সিটির সিস্টিন চ্যাপেল-এ গোপন কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ১৩৩ জন কার্ডিনাল অংশ নেন। বুধবারের প্রথম দিনটি ফলাফলবিহীন থেকে গেলেও বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনে চতুর্থ ব্যালটে প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন রবার্ট প্রিভোস্ট।
এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পর চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে ধোঁয়ার রঙ পরিবর্তনের ঐতিহ্য অনুযায়ী বেরিয়ে আসে ঘন সাদা ধোঁয়া—যার মাধ্যমে জনসাধারণ ও সংবাদমাধ্যমকে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। মুহূর্তেই ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে উপস্থিত হাজারো তীর্থযাত্রী, পর্যটক ও ভক্তগণ উল্লাসে ফেটে পড়েন, করতালিতে মুখরিত হয় চতুর্দিকে। সেই সঙ্গে বেজে ওঠে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঘণ্টাধ্বনি—যা ঐতিহ্যগতভাবে পোপ নির্বাচনের সমাপ্তি ও নতুন পোপের আগমনের প্রতীক।
সেন্ট পিটার্স ব্যালকনিতে উপস্থিত হয়ে পোপ লিও চতুর্দশ (রবার্ট প্রিভোস্ট) প্রথমবারের মতো জনসম্মুখে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, "তোমাদের সকলের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি চাই এই শান্তির অভিবাদন আমাদের হৃদয়ে ও পরিবারে প্রবেশ করুক। আমরা যেন মানবতা, সংলাপ এবং সহানুভূতির পথে এগিয়ে যাই।"
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বজুড়ে সংঘাত, বিভেদ ও ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে মুক্ত একটি মানবিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানান।
নতুন পোপ নির্বাচিত হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে রবার্ট প্রিভোস্টকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি একটি অভাবনীয় সম্মান। পোপ হিসেবে রবার্ট প্রিভোস্ট আমাদের জাতীয় গৌরবকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার ধর্মীয় প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি, সংলাপ ও নৈতিকতার নতুন যুগ সূচিত হবে বলে আমি আশাবাদী।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, পোপ লিও চতুর্দশ বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি ও মানবিকতা ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রাখবেন।”
প্রায় এক দশক ধরে পোপ ফ্রান্সিস ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পোপ হিসেবে তিনি ছিলেন উদার দৃষ্টিভঙ্গির, পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার, এবং শরণার্থীদের পাশে থাকার পক্ষে। গত ২১ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী ক্যাথলিক সম্প্রদায় গভীর শোক প্রকাশ করে। এর পর থেকেই শুরু হয় নতুন পোপ নির্বাচনের জল্পনা-কল্পনা।
পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী কার্ডিনালদের তালিকায় ইতালি, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়া এবং জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞ ও প্রভাবশালী ধর্মগুরুরা ছিলেন। অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো ইউরোপীয় দেশ থেকেই হয়তো নতুন পোপ আসবেন। তবে শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কার্ডিনাল প্রিভোস্ট একচেটিয়া সমর্থন পান।
রবার্ট ফ্রান্সিস প্রিভোস্ট জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। তিনি ছিলেন একজন উচ্চশিক্ষিত ধর্মতত্ত্ববিদ, বিশপ এবং ধর্মীয় আদর্শে অটল এক নেতা। ভ্যাটিকানে দীর্ঘদিন ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন মানবিক, শিক্ষামূলক ও মধ্যস্থতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন।
তিনি পূর্বে ছিলেন পেরুর চিকলায়োর বিশপ এবং ২০২৩ সালে তাকে ক্যাথলিক চার্চের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও ধর্মীয় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভাগ ডিকাস্টেরি ফর বিশপস-এর প্রধান করা হয়েছিল। তার নেতৃত্বে ওই বিভাগে স্বচ্ছতা ও ধর্মগুরুদের আচরণবিধি সংক্রান্ত বেশ কিছু সংস্কার আনা হয়, যা রোমান কুরিয়ায় প্রশংসিত হয়েছিল।
বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিক চার্চকে বর্তমানে একাধিক গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। শিশুশোষণ কেলেঙ্কারি, নারী ধর্মগুরুদের স্বীকৃতি, সমকামিতা বিষয়ক অবস্থান, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও আধুনিক বিশ্বে চার্চের প্রাসঙ্গিকতা—এসব বিষয়ে পোপ লিও চতুর্দশ কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন তা বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।
তবে পোপ প্রিভোস্ট তার অতীত কর্মকাণ্ডে প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি উদার, মানবিক ও সংলাপপন্থী একজন নেতা। অনেকেই মনে করছেন, তার সময়কালে চার্চ হবে আরও গ্রহণযোগ্য, আরও সমন্বিত, এবং আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সহাবস্থানে সক্ষম।
বাংলাবার্তা/এমএইচ