
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা, যাতে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন বাংলাদেশি শ্রমিক। নিহত সবাই চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নের বাসিন্দা। বুধবার সন্ধ্যার দিকে দুকুম এলাকায় ঘটে এই দুর্ঘটনা, যা স্থানীয় বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, সেদিন বিকেলের দিকে নিহতরা দুকুম উপকূলে সাগরে দিনভর কাজ শেষ করে মাইক্রোবাসে করে বাসায় ফিরছিলেন। তাঁরা সবাই সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরার কাজ করতেন এবং দিনভর ক্লান্ত শরীরে ফিরছিলেন নিজেদের আবাসস্থলে। কিন্তু হঠাৎই দুকুম মহাসড়কের একটি বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাঁদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মাইক্রোবাসটি মুহূর্তের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই আটজনের মৃত্যু হয়।
ওমান পুলিশ ও স্থানীয় গণমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, দুর্ঘটনার পরপরই স্থানীয় লোকজন ও রেসকিউ টিম ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। তাঁরা আহতদের উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান, তবে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই আট বাংলাদেশির মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেন চিকিৎসকরা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, মাইক্রোবাসটির সামনের অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মরদেহগুলো বের করতে উদ্ধারকর্মীদের বিশেষ যন্ত্রপাতির সাহায্য নিতে হয়।
নিহতদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন—আমিন সওদাগর, আরজু, রকি, বাবলু, শাহাবউদ্দিন, জুয়েল, রনি ও রাউজানের আলাউদ্দিন।
প্রত্যক্ষদর্শী সন্দ্বীপের বাসিন্দা সজীব চৌধুরী বলেন, আমরা একই এলাকায় থাকতাম। প্রতিদিনের মতো তারা সাগর থেকে মাছ ধরে প্রাইভেটকারে করে বাসায় ফিরছিলেন। তবে বাসা থেকে ১ ঘণ্টার দূরত্বে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মাছের গাড়ি ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। অনেকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নিহতদের মরদেহ দুকুম হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁরা সবাই কয়েক বছর ধরে ওমানে কর্মরত ছিলেন। কেউ কেউ মাছ ধরার নৌকায় কাজ করতেন, আবার কেউ কেউ নৌকা মেরামতের কাজ করতেন। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নে নেমে আসে শোকের মাতম। প্রতিটি বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। নিহতদের স্বজনরা বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা মোহাম্মদ আজিজ জানিয়েছেন, “আমরা ওমানের দুকুম পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত ক্লান্ত অবস্থায় ড্রাইভার হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এর ফলে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।” তিনি আরও জানান, দূতাবাসের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্তে সহায়তা করছেন।
বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইং থেকেও জানানো হয়েছে, নিহতদের পরিচয় যাচাইয়ের কাজ চলছে এবং তাঁদের মরদেহ দ্রুত দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। দূতাবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করছি। নিহতদের পরিবার যেন সব ধরনের সরকারি সহযোগিতা পায়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।”
ওমান হলো বাংলাদেশের শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক ওমানে বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন—বিশেষ করে নির্মাণ, মৎস্য আহরণ, গৃহকর্মী এবং সেবা খাতে। বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্স আয়ের একটি বড় অংশ আসে এই দেশ থেকে। ফলে সেখানে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা শুধু সাতটি পরিবারকেই নয়, বরং পুরো প্রবাসী সমাজকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান, নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। সরকারিভাবে তাঁদের মরদেহ দেশে আনতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিহতদের গ্রামের বাড়িতে এখন শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে, পুরো ইউনিয়ন যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
দুকুম পুলিশ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মাইক্রোবাসটির অতিরিক্ত গতি ও চালকের ক্লান্তি এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হতে পারে।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে নিহতদের স্মরণে স্থানীয় মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও গভীর শোক প্রকাশ করেছে এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে। “এমন দুর্ঘটনা শুধু প্রাণহানি ঘটায় না, বরং আমাদের দেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নতুন করে প্রশ্ন তোলে,” — বলেন এক প্রবাসী সংগঠনের প্রতিনিধি।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ, অথচ তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা প্রায়শই অবহেলিত থেকে যায়। দুকুমের এই দুর্ঘটনা আবারও সেই বাস্তবতাকে নির্মমভাবে সামনে এনে দিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ