
ছবি: সংগৃহীত
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে আবারও চালানো হলো অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিশেষ অভিযান। মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) রাত থেকে পর্যটনকেন্দ্রিক জনপ্রিয় এলাকা বুকিত বিনতাং জুড়ে চলা এ অভিযানে ৩৭৭ জন বাংলাদেশিসহ মোট ৭৭০ জন অবৈধ অভিবাসীকে আটক করেছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন বাস্তবায়নে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় অভিযানের অন্যতম হিসেবে এই ঘটনাকে বর্ণনা করছেন স্থানীয় গণমাধ্যম।
অভিযানে যেভাবে ধরা পড়লেন অভিবাসীরা
ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্ট বিভাগের পরিচালক বাসরি ওথমান জানিয়েছেন, ‘অপ্স বেলাঞ্জা’ নামের এই বিশেষ অভিযান স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়। অভিযোগ ছিল, বুকিত বিনতাং এলাকা অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। ফলে এলাকা ঘিরে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
অভিযান শুরু হয় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। প্রায় ১০৬ জন বিশেষ এনফোর্সমেন্ট অফিসার পুরো এলাকা জুড়ে তল্লাশি চালান। এ সময় মোট ২ হাজার ৪৪৫ জনকে যাচাই করা হয়, যাদের মধ্যে ছিলেন এক হাজার ৬০০ জন বিদেশি এবং ৮৪৫ জন স্থানীয় নাগরিক। বিস্তারিত যাচাই-বাছাই শেষে ৭৭০ জনকে আটক করা হয়।
আটক হওয়া অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশি ৩৭৭ জন, মিয়ানমারের ২৩৫ জন, ভারতের ৫৮ জন, নেপালের ৭২ জন এবং ইন্দোনেশিয়ার ১৯ জন নাগরিক রয়েছেন। আটককৃতদের মধ্যে নারীও ছিলেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।
অবৈধ বসবাস ও কাগজপত্রের অপব্যবহার
ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আটক হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই মালয়েশিয়ায় বসবাস করছিলেন। কারও ভিসার মেয়াদ অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে, কেউ কেউ আবার বৈধ কাগজপত্র থাকলেও তা অন্য কাজে ব্যবহার করছিলেন। এমনকি ভিসার শর্ত ভঙ্গ করে ভিন্ন পেশায় কাজ করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
অভিযানের সময় দেখা যায়, হঠাৎ অভিযানে অনেক বিদেশি দোকান, রেস্টুরেন্ট কিংবা ভবনের ভেতরে লুকানোর চেষ্টা করেন। কেউ কেউ আবার ছাদে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তবে পুরো এলাকা ঘিরে রাখায় শেষ পর্যন্ত তারা সবাই ধরা পড়েন।
অবৈধ অনলাইন জুয়ার আস্তানা ধরা পড়ল
অভিযানের সময় শুধু অবৈধ বসবাস নয়, আরও একটি অবৈধ কার্যক্রমের সন্ধান মেলে। কর্মকর্তারা একটি গোপন অনলাইন জুয়া কেন্দ্র চিহ্নিত করেন, যা সিসিটিভি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। সেখানে আটজন বিদেশিকে জুয়া খেলার সময় হাতেনাতে আটক করা হয়।
এ ঘটনায় শুধু অভিবাসন আইন লঙ্ঘন নয়, মালয়েশিয়ার জুয়া বিরোধী আইনেরও লঙ্ঘন হয়েছে বলে জানায় ইমিগ্রেশন বিভাগ।
আটককৃতদের পরবর্তী প্রক্রিয়া
আটক হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে তাদের পুত্রাজায়া ইমিগ্রেশন অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক স্ক্রিনিং সম্পন্ন হওয়ার পর সবাইকে ডিটেনশন ডিপোতে পাঠানো হয়েছে। এখন তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার অভিবাসন আইন অনুযায়ী তদন্ত চলছে। দোষ প্রমাণিত হলে তারা দেশে ফেরত পাঠানোসহ অন্যান্য শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।
অভিযানের বার্তা
ইমিগ্রেশন বিভাগের পরিচালক বাসরি ওথমান বলেন, “অভিযান চলাকালে আমরা দেখেছি অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় লুকানোর চেষ্টা করেছে। কেউ দোকানে, কেউ ছাদে উঠে পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের টিম পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছিল বলে সবাইকে আটক করা সম্ভব হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের অভিযান শুধু কুয়ালালামপুরেই নয়, মালয়েশিয়ার অন্যান্য প্রদেশ ও শহরেও চলবে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অবৈধ অভিবাসন রোধ করা এবং নিয়োগকর্তাদের আইন মেনে চলতে বাধ্য করা। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত বিদেশি কর্মী কোটার বাইরে গিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রেক্ষাপট ও প্রভাব
মালয়েশিয়ায় প্রায় ৮ লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক বৈধভাবে কাজ করছেন। তবে এর বাইরে আরও বিপুলসংখ্যক অভিবাসী ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও থেকে গেছেন কিংবা ভিন্ন কাগজপত্রের অপব্যবহার করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, অবৈধ অভিবাসীরা কেবল আইন লঙ্ঘন করছেন না, বরং স্থানীয়দের কাজের সুযোগও সীমিত করে ফেলছেন। পাশাপাশি অনেক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও বিদেশি নাগরিকদের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধারণা করছে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষ।
এই প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষের অবস্থান স্পষ্ট—অবৈধ অভিবাসীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। ফলে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে ইমিগ্রেশন বিভাগ।
মঙ্গলবারের অভিযানে ধরা পড়া ৭৭০ জন অভিবাসীর মধ্যে ৩৭৭ জন বাংলাদেশি। যা মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটিকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। অভিবাসন আইন লঙ্ঘনের দায়ে আটক এসব বাংলাদেশির ভবিষ্যৎ এখন আইনি প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ