
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা যখন ইসরায়েলি হামলায় কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তখন যুদ্ধ আরও তীব্র করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকার। সর্বশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসরায়েল গাজা উপত্যকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য শুধু হামাসের সামরিক শক্তিকে ধ্বংস নয়, বরং পুরো গাজা দখল করে বিজয় ঘোষণা করা—এমনটাই জানিয়েছে আলজাজিরা ও রয়টার্সসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
ইসরায়েলি এ পরিকল্পনায় নতুন করে সামরিক অভিযানের পাশাপাশি গাজার জনসংখ্যাকে দক্ষিণে সরিয়ে দেওয়ার কৌশলও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ, বাস্তুচ্যুতদের সংখ্যা আরও বাড়বে এবং পুরো গাজা খালি করার একটি পূর্বাভাসও এতে স্পষ্ট। এই সিদ্ধান্তের ঠিক আগে ইসরায়েল সরকার হাজার হাজার রিজার্ভ সেনা তলবের ঘোষণা দেয়, যা যুদ্ধের পরবর্তী ধাপের পূর্বাভাস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত ঘিরে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদিকে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির গাজায় ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে হামাসের গুদামে বোমা বর্ষণের প্রস্তাব দেন, অন্যদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জামির তার তীব্র বিরোধিতা করেন।
জেনারেল জামির বলেন, “এই ধরনের পদক্ষেপ আমাদের সবাইকে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারী হিসেবে বিপদে ফেলবে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, গাজায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানো আমাদের বাধ্যবাধকতা।” প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে হওয়া এই বাকবিতণ্ডা থামাতে হস্তক্ষেপ করতে হয় নেতানিয়াহুকেই।
এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান আরও জোরালো হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় ২৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ১৮ মাস ধরে চলা অভিযানজুড়ে ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৫২ হাজার ৫৬৭ জনে পৌঁছেছে এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার ৬১০ জন।
ইসরায়েলের নতুন পরিকল্পনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো—হামাসকে পাশ কাটিয়ে গাজায় ত্রাণ প্রবেশের নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্বীকার করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, “ইসরায়েল ওষুধ, পানি, খাদ্যসহ জীবন রক্ষাকারী পণ্যের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করে গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা এমন কোনো পরিকল্পনায় সমর্থন দেব না, যা মানবিক মূল্যবোধকে ভূলুণ্ঠিত করে।”
এদিকে, এই নতুন সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত ইসরায়েলি সমাজেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সাবেক কূটনীতিক অ্যালন পিঙ্কাস মনে করেন, “১৮ মাসে যা সম্ভব হয়নি, তা বাড়তি হামলায় অর্জন অসম্ভব।” তার মতে, অতিরিক্ত সেনা ডাকা হলেও বহু রিজার্ভ সেনা হয়তো এবার অংশ নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করবে। বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার ল্যাপিডও নেতানিয়াহুর ১০ হাজার রিজার্ভ সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, “বিনাশ ছাড়া এই অভিযানে আর কিছু অর্জন করা যাবে না।”
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় এক অন্যরকম মানবিক বার্তা এসেছে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের পক্ষ থেকে। তার পাঠানো একটি বিশেষ গাড়ি—‘পোপমোবাইল’—গাজার শিশুদের জন্য একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকে ব্যবহারের আহ্বান জানিয়ে ফিলিস্তিনে পাঠানো হয়েছে। এই গাড়িতে পোপ জনসমক্ষে আসতেন। এটি এখন যুদ্ধাক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা সহায়তার কাজে ব্যবহৃত হবে। মানবিকতার এমন বার্তা যুদ্ধের ভয়াবহতায় ক্ষতবিক্ষত গাজাবাসীর মনে একটুখানি শান্তির ছোঁয়া দিতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের নতুন দখল পরিকল্পনাকে হামাস ‘রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, “গাজার জনগণকে তারা রাজনৈতিক চক্রান্তের বলি হতে দেবে না।” এদিকে খাদ্যসঙ্কটের সুযোগ নিয়ে লুটপাট চালানো একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ছয় সদস্যকে হত্যা করেছে হামাস।
কাসসাম ব্রিগেড জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস অঞ্চলে বড় ধরনের হামলা চালিয়ে দুটি ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক ও একটি সামরিক বুলডোজার ধ্বংস করেছে। এই হামলায় তারা ‘আল-ইয়াসিন ১০৫’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
ইসরায়েলের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত শুধু গাজার ওপরই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই এক নতুন উত্তেজনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ত্রাণ প্রবেশে বাধা, বাস্তুচ্যুতির হুমকি, রিজার্ভ সেনা তলব—সব মিলিয়ে পুরো অঞ্চল জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এখন গাজা ও নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের পরিণতির দিকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ