
ছবি: সংগৃহীত
ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে ২০২৫ সালের এপ্রিলে আবারও সহিংসতা ও দমন-পীড়নের নতুন ঢেউ দেখা গেছে, যা ভারতীয় বাহিনীর 'রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস' অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে একাধিক মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিস (KMS)–এর বরাত দিয়ে পাকিস্তানের জিও নিউজ জানিয়েছে, এপ্রিলে কেবলমাত্র এক মাসেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৯ জন কাশ্মীরি প্রাণ হারিয়েছেন।
নিহতদের মধ্যে কমপক্ষে তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে কথিত ভুয়া ‘এনকাউন্টার’ বা নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অবস্থায়। এসব হত্যাকে অনেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা ভারতীয় বাহিনীর ‘নির্বিচার দমন নীতি’র অংশ বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলছে।
গণগ্রেফতারও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে
কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিস তাদের মাসিক প্রতিবেদনে আরও জানিয়েছে, এপ্রিলে পুরো অঞ্চলজুড়ে কমপক্ষে ২ হাজার ৪৮০ জন কাশ্মীরিকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেককেই আটক করা হয়েছে বিনা পরোয়ানায় এবং কোনো অভিযোগ গঠন ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে আটক রাখার অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশ গ্রেফতার করা হয়েছে রাতের অন্ধকারে অভিযান চালিয়ে, যা কাশ্মীরবাসীর মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
বেসামরিক নাগরিকদের বাড়িতে তল্লাশি, ইন্টারনেট বন্ধ রাখা, স্থানীয় গণমাধ্যমের ওপর দমন-পীড়ন চালানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বাহিনীর টহলের মতো কার্যক্রমও চলমান রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সীমান্তে টানা সপ্তম দিনের গোলাগুলি
এই অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান সীমান্তেও উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। ৩০ এপ্রিল (বুধবার) রাতেও কাশ্মীরের এলওসি (নিয়ন্ত্রণরেখা) বরাবর আবারও দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।
কাশ্মীরের পহেলগামে একটি হামলার জেরে সীমান্তের উভয় পাশেই সেনাবাহিনী চরম সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কাশ্মীর পরিস্থিতি ঘিরে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে এটি ছিল টানা সপ্তম দিনের মতো সংঘর্ষ। সামরিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সীমান্তে এই উত্তেজনা আরও বড় আকার নিতে পারে যদি কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া না হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার ইঙ্গিত
কাশ্মীর পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান জটিলতা ও সীমান্ত সংঘাতের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন তৎপর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কাশ্মীর ইস্যুতে মধ্যস্থতা চেষ্টার অংশ হিসেবে সরাসরি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ এবং ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে আলাদা ফোনালাপে কথা বলেছেন।
৩০ এপ্রিল দুই নেতার সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেন মার্কো রুবিও। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, কাশ্মীরসহ সামগ্রিকভাবে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে দুই দেশকে পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান রুবিও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতা আবারও প্রমাণ করে যে, কাশ্মীর পরিস্থিতি এখন আর কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ, অথচ ভারতের নীরবতা
এই হত্যাকাণ্ড, গণগ্রেফতার ও সীমান্ত সংঘাতের পটভূমিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ভারত সরকার এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (ধারা ৩৭০) বাতিলের পর থেকে অঞ্চলটি কার্যত সামরিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা গৃহবন্দি, বহু মিডিয়া বন্ধ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি চালানো হচ্ছে। ফলে কাশ্মীরের ভেতরের বাস্তব চিত্র বহির্বিশ্বের কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার পর্যবেক্ষকরা।
২০২৫ সালের এপ্রিল কাশ্মীরের জন্য আরেকটি রক্তাক্ত মাস হিসেবে ইতিহাসে যুক্ত হলো। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত, গণগ্রেফতার ও সীমান্ত সংঘাতে উত্তপ্ত এই সময়ে কাশ্মীর আবারও আন্তর্জাতিক কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। এখন দেখার বিষয়, এই চাপ ও উদ্বেগের মুখে ভারত সরকার কোনো ইতিবাচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয় কি না, নাকি সহিংসতা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ