
ছবি: সংগৃহীত
প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) এ এল এম ফজলুর রহমানের ফেসবুকে দেওয়া বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। তারা বলেছে, এ বক্তব্য কোনোভাবেই সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) হত্যাকাণ্ড তদন্ত কমিশনের সাবেক প্রধান এবং সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) এ এল এম ফজলুর রহমানের সাম্প্রতিক এক মন্তব্য ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। ফেসবুকে পোস্ট করা তার ওই মন্তব্যে বলা হয়েছিল, "যদি ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করে, তাহলে বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য দখল করে নেওয়া। সেই প্রেক্ষাপটে চীনের সঙ্গে যৌথ সামরিক উদ্যোগ নিয়েও আলোচনায় যাওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।"
এই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই এ মন্তব্যকে উসকানিমূলক, কূটনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এবং সংবেদনশীল বলে আখ্যা দেন। এর প্রেক্ষিতে বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাতেই প্রধান উপদেষ্টা পরিষদের প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে সরকারিভাবে বিষয়টি পরিষ্কার করেন।
সরকারের অবস্থান: এ মন্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত
প্রেস সচিব লিখেছেন, “বাংলাদেশ সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে এবং একই ধরনের শ্রদ্ধা অন্যদের কাছ থেকেও প্রত্যাশা করে। মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো অবস্থান নয়।”
তিনি বলেন, “তার মতামতকে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান হিসেবে গণ্য না করার জন্য আমরা সকল নাগরিক, কূটনৈতিক সম্প্রদায় ও গণমাধ্যমকে অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকার দৃঢ়ভাবে মনে করে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত।”
প্রেস সচিবের এই বার্তায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বা অঞ্চল দখলের বিষয়ে কোনো আগ্রাসী অবস্থান গ্রহণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না।”
বিতর্কিত পোস্ট: নিরাপত্তা ও কূটনীতির প্রশ্ন
ফজলুর রহমানের পোস্টে যে সামরিক আগ্রাসনের কল্পনা উঠে এসেছে, তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তার এই মন্তব্য ভারতের প্রতি শত্রুতার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে ভারতীয় কূটনৈতিক মহলেও আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কিছু সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সামরিক বা কৌশলগত অবস্থান নিচ্ছে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর দ্রুত ও স্পষ্ট বার্তা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
ফজলুর রহমান কে? কেন তার বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ?
মেজর জেনারেল (অব.) ফজলুর রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এবং বিডিআর বিদ্রোহ তদন্ত কমিশনের প্রধান ছিলেন। তার অতীত দায়িত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায়, অনেকেই তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেহেতু কৌশলগত ও সীমান্ত ঘনিষ্ঠ, তাই এ ধরনের মন্তব্যের কূটনৈতিক অভিঘাত হতে পারে বলে ধারণা।
তবে সরকার জানিয়ে দিয়েছে, তিনি বর্তমানে কোনও সরকারী পদে নেই এবং তার মন্তব্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, যা রাষ্ট্রীয় অবস্থান নয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাংলাদেশের নীতির স্পষ্টতা
বাংলাদেশ বরাবরই ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ — এই নীতিতে আস্থা রেখে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে আসছে। ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার।
প্রেস সচিবের বিবৃতিতে এসব বিষয় পুনর্ব্যক্ত করে বলা হয়, “সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় দায়িত্বশীলতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ওপর জোর দিচ্ছে। ফজলুর রহমানের মন্তব্য এই মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় আমরা পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছি—তা সরকার কোনোভাবেই সমর্থন করে না।”
শান্তিপূর্ণ অবস্থানের বার্তা
ফেসবুকে আলোচিত পোস্টের প্রেক্ষাপটে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরা হয়—বাংলাদেশ কারো ভূখণ্ড দখল বা সামরিক আগ্রাসনের চিন্তা করে না, বরং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তিপূর্ণ ও কূটনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান চায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ