
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকাই সিনেমা এক সময় পর্দা কাঁপানো নায়িকাদের নিয়ে গর্ব করত। মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমা কিংবা পপি—প্রতিটি নামই ছিল নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই চিত্র এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে যে প্রশ্নটা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো—ঢাকাই সিনেমার নায়িকারা কোথায় গেলেন?
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেক প্রযোজক ও পরিচালক দাবি করেন, ইন্ডাস্ট্রিতে নায়িকা ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ইমেজ, অভিনয় দক্ষতা এবং দর্শক চাহিদায় টিকে থাকার মতো অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা হাতে গোনা। আর যারা রয়েছেন, তারা কেউ ব্যস্ত রাজনীতিতে, কেউবা ইউটিউবে, আবার কেউ ডুবে আছেন ব্যক্তিগত বিতর্কে।
একসময় সুপারহিট জুটি হিসেবে পর্দায় ঝড় তোলা অপু বিশ্বাস এখন আর আগের মতো জনপ্রিয় নন। শাকিব খানের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর দর্শকের ভালোবাসার সেই জায়গা আর ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বর্তমানে সিনেমার চেয়ে ইউটিউব কনটেন্টে বেশি মনোযোগী অপু বিশ্বাস। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি "ট্র্যাপ: দ্য আনটোল্ড স্টোরি" এবং "ছায়াবৃক্ষ" সিনেমায় অভিনয় করেছেন, তবে সেগুলোর প্রভাব ছিল অল্প সময়ের জন্য।
নিরবতা, বিতর্ক ও রাজনীতির দ্বন্দ্বে মাহিয়া মাহিও হারিয়ে যাচ্ছেন। ২০১২ সালে 'ভালোবাসার রঙ' দিয়ে আলোড়ন তোলা এই অভিনেত্রী এখন রাজনীতির মাঠে হোঁচট খেয়ে ফের সিনেমায় ফিরতে চাইলেও আগের মতো দর্শক সাড়া পাচ্ছেন না। তার সর্বশেষ দেখা মিলেছে ২০২৪ সালের 'রাজকুমার' সিনেমায়, তাও একটি ক্যামিও চরিত্রে।
পরীমনি—চলচ্চিত্রের যতটা না অভিনয়ের জন্য আলোচনায়, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছেন ব্যক্তিগত বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রেম, বিয়ে, মামলা আর সোশ্যাল মিডিয়া বিতর্কে জড়ানো এই নায়িকা এখন নির্মাতাদের কাছে 'রিস্ক ফ্যাক্টর' হিসেবে বিবেচিত। ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মা’ সিনেমার পর তার উল্লেখযোগ্য কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি।
নুসরাত ফারিয়া এক সময় তরুণ প্রজন্মের আশার প্রতীক ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যর্থতা ও বিতর্কই ঘিরে রেখেছে তাকে। ‘জ্বীন-৩’ সিনেমাটি মুক্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই সরে যায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে। এর আগেও ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ সিনেমায় শেখ হাসিনার চরিত্রে অভিনয় করলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাকে ঘিরে শুরু হয় নানা সমালোচনা। এছাড়া চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় নিরব ভূমিকা ও বিতর্কিত অবস্থানও তার জনপ্রিয়তায় ছাপ ফেলেছে। তাঁর আরেকটি সিনেমা ‘ঠিকানা বাংলাদেশ’ (পূর্বের নাম ‘ফুটবল একাত্তর’) এখনও মুক্তির অনিশ্চয়তায় রয়েছে।
চলচ্চিত্রে নতুন প্রজন্মেরও যেন গতি নেই। যেসব নতুন মুখ এসেছেন, তাদের কেউ কেউ অযাচিত কর্মকাণ্ডে বিতর্কের জন্ম দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগেই শেষ করে ফেলেছেন। জাহারা মিতুর মতো নামগুলো সেই তালিকায়।
নায়িকা নিপুণও বর্তমানে কার্যত পর্দায় অনুপস্থিত। জুলাই-আগস্টে হওয়া রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে তার ভূমিকা এবং বিতর্কিত অবস্থান সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও এখন বলা চলে শুন্যের কোটায়।
একসময় যেসব নায়িকারা সিনেমার কেন্দ্র ছিলেন, এখন তারা আলোচনায় থাকছেন ব্যক্তিগত জীবনের কারণে। কারও প্রেম, কারও বিচ্ছেদ, কারও রাজনীতি, আর কারও অনলাইন কনটেন্ট—এসব বিষয়েই বেশি শোনা যাচ্ছে তাদের নাম। নির্মাতাদের ভাষ্যমতে, এই অবস্থায় তাদের নিয়ে সিনেমা নির্মাণ মানেই লোকসানের ঝুঁকি।
চলচ্চিত্রপ্রেমী, প্রযোজক-পরিচালক ও বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তব সংকটটা কেবল সংখ্যার নয়, বরং গ্রহণযোগ্যতার। দর্শক কাদের দেখতে চান, সেই চাহিদার জায়গায় ঘাটতি প্রকট। ফলে নায়িকা নির্বাচনে নির্মাতারা হচ্ছেন দ্বিধান্বিত। আর যারা কিছুটা অবস্থান তৈরি করেছিলেন, তারাও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হয়ে হারিয়ে যাচ্ছেন সিনেমা থেকে।
নব্বই দশকের গৌরবময় আমল পেরিয়ে ঢাকাই সিনেমা এখন এক শূন্যতার যুগ পার করছে, যেখানে নেই একটিও এমন নাম যাকে ঘিরে দর্শক হলমুখী হয়। এই অস্তিত্ব সংকট কাটাতে হলে প্রয়োজন নতুন মুখ, নির্মাতা সাহস, এবং সবচেয়ে বেশি দরকার দায়িত্বশীল, বিতর্কমুক্ত ও দর্শকপ্রিয় অভিনয়শিল্পীর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ