
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যরাতে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। রবিবার (১২ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১টার দিকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে উভয়পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় শাহবাগ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই ঘটনায় একাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, আহতদের মধ্যে একজন সাংবাদিকও রয়েছেন বলে জানা গেছে।
উত্তেজনার সূত্রপাত
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ শাহনেওয়াজ হলের সামনে ফুটপাতের দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে। জানা যায়, রাত ১২টার পরপরই ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী নিউমার্কেটের দিক থেকে এসে ফুটপাতের দোকান নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং তা দ্রুত সংঘর্ষে রূপ নেয়।
ঢাবির শাহনেওয়াজ হল ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা একে অপরের দিকে ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। সংঘর্ষের সময় একাধিক ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়, যা মুহূর্তেই এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। স্থানীয় দোকানপাট ও খাবার হোটেলগুলো দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়, রাস্তায় জনচলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
পুলিশ ও ছাত্রনেতাদের হস্তক্ষেপ
সংঘর্ষের খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) সাদিক কায়েমসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। তারা উভয়পক্ষকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
ডিএমপির নিউমার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, “ঢাবির শাহনেওয়াজ হলের সামনে ফুটপাতে দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে প্রাথমিকভাবে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। পরে তা উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে রূপ নেয়। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে উভয়পক্ষকে সরিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।”
তিনি আরও জানান, সংঘর্ষে কতজন আহত হয়েছেন তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে কোনো পক্ষ আবার উত্তেজনা সৃষ্টি করতে না পারে।
এলাকাজুড়ে আতঙ্ক, শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ
সংঘর্ষের সময় শাহবাগ থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত এলাকার বড় অংশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, সংঘর্ষের সময় স্থানীয় কিছু বখাটেও পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অংশ নেয়, যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়।
ঢাবির শাহনেওয়াজ হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা প্রথমে ফুটপাতের দোকান বসানো নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই অন্যপক্ষ আমাদের দিকে ইট ছুড়তে শুরু করে। পরে আমরা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিই। পুলিশ আসার পর সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।”
অন্যদিকে, ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী দাবি করেন, “ঢাবির শিক্ষার্থীরাই আগে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারা আমাদের কয়েকজনকে মারধর করেছে। পরে আমরা প্রতিরোধ করেছি।”
আহতদের অবস্থা ও তদন্তের আশ্বাস
সংঘর্ষে আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে এক সাংবাদিক আহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এলাকা টহল জোরদার করা হয়েছে। শাহবাগ, নিউমার্কেট ও আজিমপুর এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দায়ীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
এসি জাহাঙ্গীর বলেন, “আমরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি। যদি কোনো পক্ষ পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অতীতের প্রেক্ষাপট
ঢাবি ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরেই নানা ছোটখাটো ঘটনায় দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের নজির রয়েছে। বিশেষ করে নিউমার্কেট এলাকা সংলগ্ন দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট ও পরিবহন স্ট্যান্ডে প্রভাব বিস্তার নিয়ে প্রায়ই বিরোধের সৃষ্টি হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের সংঘর্ষ কেবল শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণ নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। শিক্ষার্থী সংগঠনগুলোর উচিত পরস্পরের মধ্যে সংলাপ বৃদ্ধি করা এবং প্রশাসনেরও সক্রিয়ভাবে নজরদারি বাড়ানো।
বর্তমানে পরিস্থিতি
সোমবার (১৩ অক্টোবর) ভোরের দিকে পুলিশের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। তবুও এলাকাজুড়ে এখনও টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। শাহনেওয়াজ হল, ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেট সংলগ্ন এলাকাগুলোতে শিক্ষার্থীদের চলাচল সীমিত দেখা গেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, “আমরা সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। কেউ পুনরায় সংঘর্ষের চেষ্টা করলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও জানিয়েছে, তারা উভয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে যৌথ কমিটি গঠন করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক মন্তব্য করেন, “ছাত্রদের মধ্যে সহিংসতা কখনোই সমাধান নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানই একমাত্র পথ।”
রাতের সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি এখন অনেকটা শান্ত হলেও শিক্ষার্থীদের মনে এখনো ভয় ও উদ্বেগ রয়ে গেছে—কখন আবার অস্থিরতা ফিরে আসে, সেই শঙ্কায় আছে ঢাবি ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ