
ছবি: সংগৃহীত
চলমান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিকল্পনার শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতার অভাব যে কী ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে, তার একটি বহুমাত্রিক উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত ৪০৪টি মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) এই প্রকল্পগুলোতে অর্থছাড় ও ব্যয় নিষিদ্ধ করে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশক্রমে রোববার এনইসির বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো বা সংশোধনের জন্য যেসব ন্যূনতম পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তার কোনোটিই সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকেরা (পিডি) সময়মতো গ্রহণ করেননি। ফলে এই সমস্ত প্রকল্প এখন নতুন অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ‘তারকা’ চিহ্ন দিয়ে যুক্ত করা হলেও বাস্তবে তা অচল অবস্থায় রয়ে গেছে।
আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন এই প্রসঙ্গে বলেন, "একই ভুল বারবার হচ্ছে, অথচ কারও কোনো জবাবদিহিতা নেই। প্রকল্প পরিচালকদের গাফিলতি যেমন রয়েছে, তেমনি অর্থছাড়ে দেরি, ঠিকাদারদের পালিয়ে যাওয়া কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগও অনেক সময় প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সমস্যার শেষ ঠেকায় এসে দায়টা জনগণের কাঁধে বর্তায়।" তাঁর মতে, এমন দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতাহীনতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
পরিকল্পনা কমিশন পর্যালোচনা করে দেখেছে, এসব ৪০৪ প্রকল্পের মধ্যে অনেকগুলোর মেয়াদ আগামী ৩০ জুন ২০২5 এ শেষ হয়ে যাবে। অথচ এখনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদের মেয়াদ বৃদ্ধি বা সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করেনি। এর ফলে আগামী অর্থবছরের প্রথম ৪-৫ মাস এ প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ অর্থ ছাড় বা ব্যয় করা যাবে না। ফলে কার্যত পুরো এডিপি বাস্তবায়নেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রায় প্রতিবছর একই ধরনের সংকট দেখা গেলেও এই চক্রবদ্ধ অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩৯৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প, যেগুলো আগের বছরের (২০২২-২৩) এডিপি থেকে টেনে আনা হয়। তখনও এগুলোর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল, কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও আবার প্রায় ৩০০ প্রকল্পকে একইভাবে তারকা চিহ্ন দিয়ে যুক্ত করা হয়েছিল, যা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে এখনো চলমান রয়েছে একই অনিয়ম।
নতুন অর্থবছরের এডিপিতে যুক্ত হওয়া কিছু প্রকল্পের বাস্তব চিত্র প্রকৌশলগত পরিকল্পনার চরম দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার নগ্ন উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন:
ঘোড়াশাল-৩ রিপাওয়ারিং প্রকল্প: ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১০ বছরের কাছাকাছি সময়েও কাজ শেষ হয়নি।
ময়মনসিংহ কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প: ধনুয়া থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ কাজ ২০২২ সালে শুরু হয় এবং চলতি বছরের জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অগ্রগতি প্রায় শূন্য।
বিআরটি সিএনজি এসি বাস প্রকল্প: ২০২৩ সালে শুরু হয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হলেও এখনো একটি বাসও আসেনি। অথচ অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। কোরিয়ার তৈরি বাসগুলোতে দরজার দিক নিয়ে ঝামেলা থাকায় এখনো দরজার রূপান্তরসহ কেনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি।
কালিয়া সেতু নির্মাণ প্রকল্প: ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই সেতুর কাজ এখনও থেমে রয়েছে। সংশোধন বা মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শুরু করা হয়নি।
সৈয়দপুর-নীলফামারী মহাসড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প, থানচি-রিমাকরি-মদক-লিকরি সড়ক নির্মাণ প্রকল্প, নলকা-সিরাজগঞ্জ-সয়দাবাদ চারলেন প্রকল্প: প্রত্যেকটি প্রকল্পই ২০১৭ সালের আশপাশে শুরু হয়ে আজও অসমাপ্ত। মেয়াদও শেষ, সংশোধনের উদ্যোগও নেই।
অর্থছাড় স্থগিত হওয়া আরও কিছু প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে:
সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রজেক্ট
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের লেভেলক্রসিং গেট পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন
৫০টি বিজি এবং ৫০টি এমজি রেল কোচ নির্মাণ
আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ
কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্প
এসব প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে আটকে থাকার কারণে দেশের রেল যোগাযোগের আধুনিকায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা ও দায়িত্বহীনতা শুধু উন্নয়ন কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকাও অপচয় হচ্ছে। তারা বলছেন, প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা না গেলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
প্রতি বছর শত শত মেয়াদোত্তীর্ণ প্রকল্প নতুন এডিপিতে যুক্ত হওয়া, সেগুলোর জন্য বিশেষ চিহ্ন দিয়ে বরাদ্দ রাখা এবং পরবর্তী বছর আবার একইভাবে স্থগিত রাখা—এই ধারাবাহিক অনিয়মই দেশের উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় ‘প্রশাসনিক সংস্কার’ ও ‘কঠোর জবাবদিহিতা’ এখন কতটা জরুরি তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। জনগণের অর্থ যেন অদূরদর্শিতা ও অবহেলার বলি না হয়, সে নিশ্চয়তা দেওয়াই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ