
ছবি: সংগৃহীত
সুন্দরবন—বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণভোমরা। বনজ সম্পদ আহরণ, জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে এ বনের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এই বন আজ শুধু প্রকৃতির আশীর্বাদ নয়, মানুষের জন্য হয়ে উঠেছে এক ভয়াল অভিশাপও। কারণ গভীর সুন্দরবনের অনেক এলাকাতেই বর্তমানে একটি ছায়া-প্রশাসনের আদলে রাজত্ব চালাচ্ছে জলদস্যুরা। এ রাজত্বে ঢুকতে হলে চাই অনুমতি, গুনতে হয় মাশুল। আর নিয়ম না মানলেই জেলে, মৌয়াল বা বাওয়ালিদের জিম্মি করে নির্যাতন, মুক্তিপণ আদায় বা সম্পদ ছিনতাই এখন রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে দস্যু বাহিনীর।
খুলনার দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, ও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ-সর্বত্র সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী জেলেপল্লিগুলোতে আতঙ্কের নাম এখন জলদস্যু। গত ছয় মাসে অন্তত ১০০ জনের বেশি জেলে ও বনজীবী অপহরণ হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এদের প্রত্যেককেই মুক্তি পেতে হয়েছে বিকাশ বা নগদ অ্যাপে টাকা পাঠিয়ে—পরিমাণ ২০ হাজার থেকে শুরু করে কখনও কখনও ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যারা অর্থ দিতে পারেনি, তাদের ভাগ্যে জুটেছে নির্মম শারীরিক নির্যাতন।
দাকোপ উপজেলার জেলে ফারুক হোসেন জানান, মাছ ধরতে গিয়ে সম্প্রতি জলদস্যুদের কবলে পড়েন। “চারজনকে জিম্মি করে গভীর বনে নিয়ে যায় তারা। খাবার দেয় না, মোবাইল কেড়ে নেয়। দিনভর বেঁধে রাখে, রাত হলে আবার ভয় দেখায়। অবশেষে বাড়ি থেকে টাকা পাঠালে ছাড়া পাই।”
শ্যামনগরের জেলে রবিউল শেখ বলেন, “ছয়জনকে একসঙ্গে ধরে নেয়। টাকা পাঠাতে দেরি হওয়ায় একজনকে নির্যাতন করে—আমরা বাকিরা আতঙ্কে কাঁপছিলাম।”
জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুন্দরবনে শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনীসহ অন্তত সাত থেকে আটটি জলদস্যু গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা গড়ে আট থেকে দশজন। এদের কাছে দেশীয় রাইফেল, দো-নালা বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র থাকে। মূলত সুন্দরবনের নির্জন অঞ্চলগুলোতে তাঁবু গেড়ে এই বাহিনীগুলো নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। বনে প্রবেশের সময় মৌখিক অনুমতি না নিলে কিংবা টাকা না দিলে তাদের টার্গেট হন জেলেরা।
একাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ভাষ্যমতে, ‘এই বাহিনীগুলোর মদদদাতা রয়েছে উপকূলের রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের ভেতর। তাদের আশ্রয়েই বারবার নতুন বাহিনী জন্ম নিচ্ছে।’
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান জানান, ‘গত ছয় মাসে পরিচালিত অভিযানে ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬০টি দেশীয় অস্ত্র, গুলি ও হাতবোমা উদ্ধার করা হয়েছে। ধরা হয়েছে ১৯ জন জলদস্যু, মুক্ত করা হয়েছে ৩৭ জন অপহৃত জেলে।’ তিনি জানান, “সুন্দরবনের গভীরে বেশ কিছু দস্যু আস্তানার হদিস মিলেছে। সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেউ দস্যুতা করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
তবে স্থানীয়ভাবে অনেকে মনে করেন, এসব অভিযান ধাক্কা দিতে পারলেও শেকড় উপড়ে ফেলতে পারছে না। কারণ প্রতিটি বাহিনী একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে, এবং দস্যুদের জন্য বনটি হয়ে উঠেছে আত্মগোপনের এক আদর্শ জায়গা।
সুন্দরবন বন বিভাগের বন সংরক্ষক মো. ইমরান হোসেন বলেন, “জলদস্যু নির্মূল করা শুধু বন বিভাগের একার দায়িত্ব নয়। এজন্য আমরা কোস্ট গার্ড, র্যাব, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনীর সহায়তা চেয়েছি। সম্প্রতি একাধিক সফল অভিযান হয়েছে। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনতে হলে দীর্ঘমেয়াদে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আমরা ইতোমধ্যে একটি আলাদা মনিটরিং ইউনিট গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছি।”
সুন্দরবনে জলদস্যুদের এমন দাপট স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতা কী ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেখানে সাধারণ মানুষ তাদের রুটিন পেশা—মাছ ধরা, মধু সংগ্রহ বা কাঠ কাটা—নিয়ে জীবন চালায়, সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হতাশাজনক।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, বনজ সম্পদের ব্যবহার এখন আর শুধু দুর্নীতির কবলে পড়া নয়, বরং তা অস্ত্রধারী দস্যুদের আখড়া হয়ে উঠেছে। এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সমন্বিত, নিরবচ্ছিন্ন এবং দুর্নীতিমুক্ত অভিযানে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, নইলে অচিরেই গহীন সুন্দরবন হয়ে উঠবে দস্যুদের স্বাধীন প্রজাতন্ত্র।
সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করার লড়াই এখন শুধু আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পরীক্ষা। একটি ছায়া-সরকার যদি আমাদের জাতীয় বনের গভীরে জন্ম নিতে পারে, তবে তা আমাদের আইনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় নীতির দেউলিয়াপনারই বড় দলিল। এই বাস্তবতায় সরকারের সামনে এখনই জরুরি প্রশ্ন—আর কতটা দেরি হলে দস্যুদের সঙ্গে মানুষের লড়াইটা শেষ হবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ