
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ৯ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য সফরে যাচ্ছেন। এই সফরটি কেবল একটি কূটনৈতিক ভ্রমণ নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব পুনরায় সক্রিয় করার একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সফরে অংশ নিচ্ছেন এবং এই সফরের বিস্তারিত কর্মসূচি এখনও প্রণয়নাধীন রয়েছে। তবে কূটনৈতিক মহলের ধারণা, সফরকালে ড. ইউনূস ব্রিটেনের রাজা চার্লস তৃতীয় এবং নতুন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন। এসব বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের কৌশলগত সম্পর্ক, গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ভবিষ্যৎ, এবং বহুমাত্রিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক উদ্যোগ
সফরের মূল এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যকে এই পাচার অর্থের অন্যতম গন্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। এই সফরে ড. ইউনূসের সঙ্গে থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), অর্থ মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা, যাদের উদ্দেশ্য হবে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথ প্রক্রিয়ায় অর্থ পুনরুদ্ধারের পথ তৈরি করা।
সূত্র জানায়, চীনে সাম্প্রতিক সফরের পর যুক্তরাজ্য সফরটিকে সরকারের পক্ষ থেকে “অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কূটনৈতিক উদ্যোগ” হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ এই সফর একইসঙ্গে রাজনৈতিক সংকট নিরসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে।
হাই-প্রোফাইল দুর্নীতি, আত্মগোপন ও লন্ডন সংযোগ
এই সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হচ্ছে—বাংলাদেশ থেকে পলাতক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের অবস্থান যুক্তরাজ্যে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন, এবং সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও তার পরিবার যুক্তরাজ্যেই রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানুয়ারি মাসে পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করেছে, যার মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ রেহানার মেয়ে এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, এবং শেখ রেহানার ভ্রাতুষ্পুত্রী আজমিনা সিদ্দিক।
আলজাজিরা তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ৫০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি ব্যয়ে লন্ডন, দুবাই ও নিউইয়র্কে বিলাসবহুল সম্পত্তি কিনেছেন, কিন্তু এসব সম্পদের কোনো তথ্য বাংলাদেশে দাখিলকৃত তার আয়কর রিটার্নে উল্লেখ নেই।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার হচ্ছে এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পাচার হওয়া রাষ্ট্রীয় অর্থ জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনা। এই সফর সে অঙ্গীকার বাস্তবায়নের একটি কার্যকর অংশ।
রোহিঙ্গা সংকটে যুক্তরাজ্যের সমর্থন আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা
এছাড়া সফরে রোহিঙ্গা সংকটও একটি মুখ্য আলোচ্য বিষয়ের তালিকায় রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন সহায়তা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএইড থেকে অর্থায়ন হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার নতুন উৎস থেকে সহায়তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তরাজ্যকে রোহিঙ্গা সংকটে নতুনভাবে অর্থায়নে যুক্ত করতে চাইছে ঢাকা।
বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অতিরিক্ত অর্থ সহায়তা প্রয়োজন, যা আগামী বছরের মধ্যে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আগে পাকা চুক্তিতে রূপ দিতে চায় সরকার।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন ও বিনিয়োগ আকর্ষণ
যুক্তরাজ্যে বর্তমানে ছয় লাখেরও বেশি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিক বসবাস করেন। এই বিপুল জনগোষ্ঠী দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ড. ইউনূসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবেন এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবেন।
প্রধান উপদেষ্টা প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ সংলাপ বা নেটওয়ার্কিং সভাও আয়োজন করতে পারেন, যেখানে তিনি তাদের দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানাবেন।
সফরের গুরুত্ব
এই সফরটি একদিকে যেমন একটি উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক অঙ্গীকার, অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক বার্তা—যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের ঘোষণা দিতে চায়। যুক্তরাজ্য সফরের মধ্য দিয়ে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জনের আশা করছে সরকার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ