
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রশাসনে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে অভিযুক্ত আমলাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে নতুন উদীয়মান রাজনৈতিক ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘জুলাই ঐক্য’। মঙ্গলবার (২০ মে) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনটি সচিবালয়ে কর্মরত আওয়ামী লীগের ‘ঘনিষ্ঠ সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত ৪৪ জন আমলা এবং প্রশাসনের আরও ৫০ জন কর্মকর্তার একটি বিস্তৃত তালিকা প্রকাশ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনের শিরোনাম ছিল, ‘সচিবালয়ে ও প্রশাসনে কর্মরত ফ্যাসিবাদের দোসরদের তালিকা প্রকাশ’। এটি শুধু একটি সংবাদ সম্মেলনই নয়, বরং বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর গভীরভাবে আস্থা হারানোর প্রকাশ এবং একটি কার্যকর সংস্কারের দাবিতে জোরালো রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জুলাই ঐক্যের মুখপাত্র ও অন্যতম সংগঠক মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ। তিনি বলেন, “গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে যারা জনগণের ট্যাক্সে বেতন নিয়ে শেখ হাসিনার দলীয় শাসনকে ত্রাণকর্তার মতো রক্ষা করেছে, তারাই আজ সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণে। অথচ প্রশাসন একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও প্রজাতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিচালিত হওয়ার কথা।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু জুলাই-আগস্ট মাস নয়, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এই আমলারা দেশব্যাপী রাজনৈতিক নিপীড়নের অংশ হয়ে উঠেছে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সহযোগী। এই ধরণের আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।”
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন শহিদ মুহতাসির রহমান আলিফের বাবা মোহাম্মদ গাজীউর রহমান। তিনি সংবাদ সম্মেলনের অংশ হিসেবে সরকারের দোসর আমলাদের তালিকা থেকে ৪৪ জনের নাম পড়ে শোনান। এ তালিকায় সচিবালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, এমনকি কয়েকজন মাঠপ্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার নামও রয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসনের আরও প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তার নামও তালিকায় উঠে এসেছে, যাদের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এখানেই থেমে থাকেনি জুলাই ঐক্য। সংবাদ সম্মেলনে তারা একটি সুসংগঠিত ও বিস্তারিত আট দফা দাবি উত্থাপন করে। দাবি অনুযায়ী—
জুলাই ঐক্যের আট দফা দাবি:
১. বাধ্যতামূলক অবসর: তালিকায় উল্লিখিত ‘সন্ত্রাসী দলের দোসর’ আমলা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আগামী ৩১ মে’র মধ্যে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে হবে।
২. তদন্ত কমিটি গঠন: তিন কর্ম দিবসের মধ্যে স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান অগ্রগতি জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
৩. সম্পদ জব্দ: ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালানো, নির্দেশ প্রদান এবং সহযোগিতাকারী সকল আমলা ও তাদের পরিবারের অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে হবে।
৪. বিদেশে যাওয়া নিষেধাজ্ঞা: এইসব কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে এবং প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. শ্বেতপত্র প্রকাশ: চিহ্নিত স্বৈরাচারের দোসরদের একটি শ্বেতপত্র সরকারিভাবে ৫ আগস্টের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।
৬. আইনের ১৩২ ধারা বাতিল: আইনের ১৩২ ধারা বাতিল বা সংশোধন করে খুনি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পথ উন্মুক্ত করতে হবে।
৭. সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া তালিকা: সেনানিবাসে আশ্রয় নেওয়া ৬২৬ জনের তালিকা এবং তাদের দেশত্যাগের সহযোগীদের তথ্য প্রকাশ করতে হবে।
৮. কালচারাল ও পেশাগত পর্যালোচনা: পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন ও গণমাধ্যম খাতেও আওয়ামী লীগপন্থী ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ দোসরদের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
জুলাই ঐক্যের দাবি অনুযায়ী, এই তালিকা শুধু একটি অভিযোগনামা নয়, বরং এটি একটি নৈতিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা। তারা মনে করে, প্রশাসনের যারা দলীয় নির্দেশনায় জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, তাদের চিহ্নিত না করলে রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনই গণতান্ত্রিক পথে ফিরবে না।
সংগঠনটি মনে করে, প্রশাসনে দলীয় দোসরদের প্রভাব থাকার ফলে বিরোধী মতের প্রতি সহিংসতা, অন্যায় গ্রেপ্তার, নিখোঁজ, গুম এবং বেআইনি সম্পদ অর্জনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া থামাতে হলে শুধু রাজনীতির নয়, প্রশাসনেরও বিশুদ্ধিকরণ জরুরি।
তাদের ভাষায়, “রাষ্ট্রের কোনো অংশ ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করলে, সেটিকে গণতন্ত্রের বাহনে চেপে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।” এজন্যই তারা তাদের কর্মসূচিকে পর্যায়ক্রমে প্রশাসনের বাইরের অন্যান্য সেক্টরেও ছড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
জুলাই ঐক্যের এ ধরণের প্রতিবাদ ও উদ্যোগ দেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যদিও সরকারি পর্যায়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি, তবে তালিকাভুক্ত আমলারা আগামীতে কী প্রতিক্রিয়া দেন, কিংবা সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে কিনা, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে দেশবাসী। এই প্রতিবেদন দেশের প্রশাসন এবং গণতন্ত্রচর্চার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ