
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের অনুরোধে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠাতে ‘মানবিক করিডর’ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশে তীব্র বিতর্ক এবং উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সরকার বলছে, এটি করিডর নয় বরং ‘প্যাসেজ’, তবে এই বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ কৌশলগত ভারসাম্যের জন্য গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু, যা কোনো ধরনের গোপনীয়তা বা একক সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডরের অনুরোধ জানান। এরপরই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ঘোষণা দেন, সরকার নীতিগতভাবে মানবিক করিডর অনুমোদন দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কোথা থেকে কীভাবে শুরু হলো, কে বা কারা সিদ্ধান্ত নিল, কী আলোচনা হয়েছে—এসব বিষয়ে সরকার নিরুত্তর।
অন্যদিকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, এটি করিডর নয়, বরং "প্যাসেস"। তবে করিডর ও প্যাসেজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী, সেটি তিনি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেননি, যার ফলে জনগণের মাঝে আরও বিভ্রান্তি এবং উদ্বেগ বাড়ছে।
প্রখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এম মুনীরুজ্জামান সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন করিডর পরিকল্পনার যৌক্তিকতা নিয়ে। তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সার্বভৌম সীমান্তে কিছু পাঠাতে হলে সে দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সম্মতি প্রয়োজন। সে রকম কোনো সম্মতির বিষয় আমরা জানি না।”
তিনি আরও বলেন, “রাখাইন একটি জটিল সংঘাতপূর্ণ এলাকা। সেখানে করিডর স্থাপন করে মানবিক সাহায্য পাঠাতে গেলে বাংলাদেশ নিজেকে সরাসরি ওই সংঘাতে যুক্ত করে ফেলবে। আন্তর্জাতিকভাবে যে রীতি প্রচলিত, তা হলো সংঘাতপূর্ণ প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখা—না যে সেখানে সম্পৃক্ত হয়ে পড়া।”
তাঁর মতে, এই ধরনের একটি বড় এবং স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের এককভাবে নেওয়া উচিত নয়। সংসদ না থাকলেও অন্তত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বারবার ইতিহাসের উদাহরণ টেনে দেখিয়েছেন, মানবিক করিডর কীভাবে দখলদারিত্ব, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের অজুহাত হয়ে উঠেছে। যেমন:
বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় জাতিসংঘ মানবিক করিডর স্থাপন করেছিল, পরবর্তীতে সেখানে ন্যাটোর স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে ওঠে।
ইরাকে “নো ফ্লাই জোন” দিয়ে শুরু হয়েছিল, আজ সেখানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি।
লিবিয়ায় মানবিক করিডরের মাধ্যমে বেনগাজিতে প্রবেশ করে মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেশটিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় পশ্চিমা জোট।
সিরিয়ার আলেপ্পো, ইদলিব, রাক্কা এলাকায় মানবিক করিডরের আড়ালে পশ্চিমারা গৃহযুদ্ধে জড়ায় এবং ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে সে দেশটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবু রূশ্দ বলেন, “এই বিষয়ে জনগণকে জানানো উচিত ছিল। সরকার ট্রান্সপারেন্সি রাখেনি বলেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। করিডর মানে জনগণের মনে হয়েছে, কেউ যেন আমাদের ভূমি নিয়ে নিচ্ছে। অথচ আসল বিষয়টা হচ্ছে জাতিসংঘ আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে খাদ্য-চিকিৎসাসামগ্রী পাঠাতে চায়।”
তিনি আরও বলেন, “এই করিডরের কার্যকারিতা নির্ভর করে মিয়ানমারের সম্মতির উপর। রাখাইন এখন আরাকান আর্মির দখলে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী অনেকটা হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোর্টগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। ফলে করিডরটা আসলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করেই করতে হবে।”
তিনি দাবি করেন, সরকার এই বিষয়টি হুট করে ঘোষণা করে ফেলেছে, অথচ এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের রাজনৈতিক দল, নিরাপত্তা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সেক্টরের মতামত নেওয়া উচিত ছিল।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, “মার্চে রাখাইনে মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছিল। খাদ্য, ওষুধ, ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র ঘাটতি ছিল। তখন থেকেই জাতিসংঘ করিডরের প্রস্তাব তোলে। বাংলাদেশ এতে রাজি হলে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চাপ কমতে পারে এবং জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশের কাছ থেকে সহযোগিতা বাড়তে পারে।”
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “মানবিক করিডর খুব স্পর্শকাতর বিষয়। সামরিক প্রসঙ্গ চলে আসে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, কুর্দিস্তান, বসনিয়া, ইউক্রেনে করিডরই বড় ধরনের নিরাপত্তা সংকটের জন্ম দিয়েছে।”
বিএনপির পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ না দেখে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। করিডর দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের পাশে দাঁড়ানো একপ্রকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।”
তারা প্রশ্ন তুলেছে—মিয়ানমার তো মানবিক সহায়তা চায়নি, তাহলে বাংলাদেশ কেন এমন আগ্রহ দেখাচ্ছে? আরাকান আর্মি তো রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কোনো আশ্বাসও দেয়নি, বরং নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়ন করছে।
বায়েজিদ সরোয়ারের ভাষ্য, “রাখাইনে যেহেতু ভূমিকম্পের মধ্যেও সেনাবাহিনী বোমাবর্ষণ চালিয়েছে, সেখানে করিডর দিয়ে সাহায্য পাঠাতে গেলে সহায়তা দল হামলার শিকার হতে পারে। তাই করিডর না করে বাংলাদেশের বিকল্প ভূমিকা খুঁজে দেখা উচিত। যেমন—জাতিসংঘ কর্তৃক নিরপেক্ষ পরিবহণ ব্যবস্থার প্রস্তাবনা।”
বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও ভূরাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর দেশের জন্য মানবিক করিডরের মতো সিদ্ধান্ত কেবল মানবতাবাদী বিবেচনায় নয়—জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক কৌশলগত ভারসাম্য বিবেচনা করে নেওয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে বলছেন—এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল সরকারকে নয়, গোটা জাতিকে দীর্ঘমেয়াদে বিপদে ফেলতে পারে। অতএব এখনই সময়, সরকারের উচিত হবে এই বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা শুরু করা, সংসদ না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এমন সিদ্ধান্ত এককভাবে, গোপনে, তাড়াহুড়ো করে নেওয়া—রাষ্ট্রচিন্তার ঘোরতর অবহেলা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ