
ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও সীমান্তে উত্তেজনা কমার বদলে ক্রমেই বাড়ছে। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সামরিক কৌশল ও কূটনৈতিক পদক্ষেপে টানাপোড়েন অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের এক বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি ভারতের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। জয়শঙ্কর স্বীকার করেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি ভারতীয় সামরিক অভিযানের আগেই পাকিস্তানকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল।
শনিবার (১৭ মে) প্রকাশিত ভারতের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বলেছেন, অপারেশনের শুরুতেই ইসলামাবাদকে জানানো হয়েছিল যে ভারত সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালাবে, তবে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি নিশানায় নেওয়া হবে না। পাকিস্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা নিজেদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারে।
এই অপ্রত্যাশিত তথ্য ফাঁস হওয়ার পর ভারতীয় বিরোধী দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও তীব্র সমালোচনা শুরু করেছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (এক্স) লেখেন, ‘যুদ্ধের আগে পাকিস্তানকে হামলার কথা জানানো ছিল একটি বড় অপরাধ। এতে আমাদের দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জীবন সংকটে পড়ে।’ তিনি আরও প্রশ্ন তুলেছেন, এই আগাম তথ্য দেওয়ার ফলে পাকিস্তান কত ভারতীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে পেরেছে?
রাহুল গান্ধী জয়শঙ্করের বক্তব্যের একটি ভিডিও শেয়ার করে বলেছেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে, অপারেশনের আগে পাকিস্তানকে জানানো হয়েছিল। তাহলে জানা দরকার, কে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? এবং আমাদের বিমান বাহিনী কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি জাতির কাছে বিস্তারিত জানানো জরুরি।’
অন্যদিকে ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) দাবি করেছে যে, জয়শঙ্করের বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তা বিকৃত অর্থে পরিবেশন করা হচ্ছে। তবে ওই ভিডিওতে জয়শঙ্করের ‘অগ্রিম বার্তা’ দেওয়ার কথাটি পরিষ্কার শোনা গেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেনি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ভারতের আরও একটি রাজনৈতিক দল, আম আদমি পার্টি (AAP) এই বিষয়টি ‘দেশদ্রোহিতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আম আদমি পার্টির রাজ্যসভার সদস্য সঞ্জয় সিং বলেছেন, ‘এটি শুধু অবিবেচনার কাজ নয়, বরং রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাকিস্তানকে আগাম জানানো মানেই ভারতের সেনাবাহিনীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জাতির কাছে স্পষ্টভাবে জবাব দিতে হবে।’ তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, ‘সরকার কি ইচ্ছাকৃতভাবেই এ তথ্য ফাঁস করেছে নাকি এটি ছিল উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ? দেশের মানুষ এই প্রশ্নের জবাব পেতে حق রাখে। না হলে এর পুরো দায় মোদি সরকারকে বহন করতে হবে।’
‘অপারেশন সিঁদুর’ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি নির্দিষ্ট ও গোপন অভিযান, যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সীমান্তের ওপারে সন্ত্রাসী ঘাঁটি ধ্বংস করা। তবে এই অভিযানের আগেই পাকিস্তানকে জানানোয় সামরিক কৌশল ও কূটনৈতিক বিচারে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক মনে করছেন, এ সিদ্ধান্ত সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে লাভের চেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হয়েছে। কারণ পাকিস্তান আগাম প্রস্তুত হয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবেলা ও প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে, যা ভারতীয় বাহিনীর জন্য বিপদ ডেকে এনেছে।
এছাড়াও, কূটনৈতিকভাবে এ ধরনের আগাম তথ্য জানানো ভারতের অবস্থান দুর্বল করেছে বলে মনে করছে একাংশ। বিশেষ করে যখন ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক এতটাই টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে, তখন এই ধরনের গোপন তথ্য ফাঁস কৌশলগত ভাবে ভারতের স্বার্থ বিরোধী হতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, এস জয়শঙ্করের এই স্বীকারোক্তি ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক নীতিতে গভীর প্রশ্ন তোলে। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে উত্তেজনা ও তীব্র বিতর্কের ঝড় বইয়ে দিয়েছে। দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গোপনীয়তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে এবার নতুনভাবে আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। আগামী দিনে এই ঘটনায় রাজনৈতিক চাপ, তদন্ত কিংবা সরকারি ব্যাখ্যার জন্য চাপ বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এই ঘটনার পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার তীব্রতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যত কেমন হবে তা নিয়ে এখন দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ