
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচারের সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম হয়ে উঠেছে অবৈধ হুন্ডি। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো না গেলে একদিকে যেমন সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, অন্যদিকে দিনে দিনে হুন্ডি নির্ভর হয়ে উঠছে একটি প্রজন্মের বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থা। বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসীদের শ্রমে অর্জিত অর্থ, নানা জটিলতায় ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো সম্ভব না হওয়ায়, তারা বাধ্য হচ্ছেন হুন্ডির দ্বারস্থ হতে। আধুনিক প্রযুক্তি, অ্যাপ-নির্ভর যোগাযোগ এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবার এজেন্টদের সহায়তায় গড়ে উঠেছে একটি সুসংগঠিত অপরাধচক্র। যার মাধ্যমে নির্বিঘ্নে এবং প্রায় প্রমাণ ছাড়া দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে।
দুই দশকে পাচার ২৮ লাখ কোটি টাকা: হুন্ডিই প্রধান হাতিয়ার
বাংলাদেশের আর্থিক খাত বিশ্লেষণ করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা। এসব অর্থ পাচারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল হুন্ডি ব্যবসা, যার সুবিধাভোগী ছিলেন সেই সময়কার শাসক দলের (আওয়ামী লীগ) প্রভাবশালী নেতা, আমলা এবং ব্যবসায়ীরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচারের প্রকৃত অঙ্ক হয়তো আরও বেশি। কারণ এই অদৃশ্য লেনদেনের কোনো কাগজপত্র বা ব্যালান্স শিটে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, “হুন্ডি এমন একটি ছায়া অর্থনীতি তৈরি করেছে, যা বৈধ অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে। এই চক্রের সঙ্গে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, এমনকি ব্যাংকিং সেক্টরের সংশ্লিষ্টরাও সম্পৃক্ত।”
হুন্ডির নেপথ্যে যে চক্র
হুন্ডি কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার মতে, হুন্ডির কারবারিরা এখন কৌশল পাল্টেছে। তারা বিভিন্ন এনক্রিপ্টেড অ্যাপ যেমন— IMO, WhatsApp, Signal, Telegram ইত্যাদির মাধ্যমে গোপন চক্র গড়ে তুলেছে। এসব অ্যাপে প্রবাসী প্রেরকের সঙ্গে দেশের গ্রাহক বা এজেন্টদের সংযোগ ঘটানো হয়। পরে প্রবাসী ওই অ্যাপে তার আত্মীয়ের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের তথ্য দিয়ে টাকা পাঠান। দেশে সেই তথ্য যাচাই করে নির্ধারিত গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়ে দেয় চক্রের স্থানীয় সদস্য।
সিআইডি সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে হুন্ডি চক্রের সহায়তাকারী হিসেবে শতাধিক এমএফএস এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট ও ঢাকার কয়েকটি এলাকায় এসব কার্যক্রম বেশি সক্রিয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামের কয়েকটি চক্র খুব সংগঠিতভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুন্ডির টাকা পৌঁছে দিচ্ছে।
বিচ্ছিন্ন কিছু উদাহরণ, কিন্তু একই কৌশল
সিআইডি তদন্তে উঠে এসেছে অন্তত ৫০টি ঘটনার তথ্য, যেখানে প্রবাসীরা নানা কারণে বৈধ উপায়ে টাকা পাঠাতে না পেরে হুন্ডি ব্যবহার করেছেন। যেমন সাভারের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। আকামা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে না পারায় তিনি একটি হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে প্রতি মাসে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। তার বোনজামাইয়ের বিকাশ অ্যাকাউন্টে প্রায় নিয়মিতই টাকা জমা হয়, যা সিআইডির নজরে আসে।
একইভাবে কুষ্টিয়ার আরেক প্রবাসী, যিনি সৌদিতে আছেন বহু বছর ধরে, তিনিও আকামা জটিলতায় বৈধপথে টাকা পাঠাতে না পেরে একই কৌশল গ্রহণ করেছেন।
আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর হুন্ডি চক্র
সিআইডি’র ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে হুন্ডির লেনদেন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। যেহেতু টাকার উৎস ও প্রেরক একই সঙ্গে যাচাই করা সম্ভব হয় না, তাই এই পদ্ধতিকে নির্বিঘ্ন মনে করেন হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো প্রমাণ না থাকায়, আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করাও দুরূহ।
অতিরিক্ত আইজিপি (চলতি দায়িত্ব) মো. ছিবগাত উল্লাহ বলেন, “হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে যে বিপুল অর্থ দেশ থেকে পাচার হয়েছে, তা শনাক্ত ও ফেরত আনার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করছি। বেশ কিছু মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। ভবিষ্যতে যেন কেউ অর্থ পাচার করতে না পারে, সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।”
সাবেক মন্ত্রীদের পরিবার জড়িত, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগ
সিআইডির একটি মামলা অনুসারে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আত্মীয়স্বজন হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন। তার খালাতো ভাই মো. মামুন সালাম ও মামুনের স্ত্রী কানিজ ফাতেমাসহ আটজনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে।
সিআইডি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্র জানায়, দুবাই, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তানে বাংলাদেশি হুন্ডি চক্রের শাখা রয়েছে। এইসব দেশের মুদ্রায় টাকা নিয়ে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সমপরিমাণ টাকা পাঠানো হচ্ছে, অথচ আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। বরং উল্টোভাবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।
বিদেশগামীদের ৪৯ শতাংশ আয়ই হুন্ডিতে যায়, সরকার হারায় রাজস্ব
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, বর্তমানে দুই কোটির বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। কিন্তু প্রবাসী আয় হিসেবে যা রেকর্ড হচ্ছে, তার চেয়ে বাস্তব আয় অনেক বেশি। কারণ, অর্থনীতিবিদ ও গোয়েন্দা সংস্থার মতে, বৈধ রেমিট্যান্সের বাইরে ৪৯ শতাংশ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, “যদি এই ৪৯ শতাংশ অর্থ বৈধ পথে দেশে আসতো, তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক বেশি হতো। এই প্রবণতা রোধ না করা গেলে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।”
হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ না করলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার
হুন্ডি ব্যবসা এখন আর কেবল ‘প্রবাসীর পথ’ নয়, এটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা দুর্নীতির অন্যতম সরঞ্জাম। যারা বিদেশে বৈধভাবে টাকা পাঠাতে পারে না, কিংবা যারা দেশ থেকে অবৈধভাবে আয় করা অর্থ বিদেশে পাঠাতে চায়—তাদের জন্য হুন্ডি একটি ‘নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য’ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। মোবাইল ব্যাংকিং ও প্রযুক্তিনির্ভর এই গোপন চক্র ভেঙে ফেলা না গেলে বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, রাজস্ব ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
সরকারের উচিত অবিলম্বে:
হুন্ডিতে জড়িত অ্যাপ ও চক্র শনাক্তে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন
হুন্ডি লেনদেনে ব্যবহৃত এমএফএস এজেন্টদের শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা
প্রবাসীদের জন্য আকামা সমস্যায় বিকল্প বৈধ রেমিট্যান্স চ্যানেল তৈরি
হুন্ডির চাহিদা কমাতে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহমূলক প্রণোদনা বৃদ্ধি
অন্যথায় প্রবাসীদের কষ্টের টাকা যেমন হুন্ডির মাধ্যমে হারাবে বৈধতা, তেমনি রাষ্ট্র হারাবে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ভিত্তি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ