
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও আলোচিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নুসরাত ফারিয়াকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়েছে। রবিবার (১৮ মে) ভোরে তিনি থাইল্যান্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম সম্পন্ন করছিলেন, ঠিক তখনই ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। এরপর প্রথমে তাকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয় এবং পরে ভাটারা থানা পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
বর্তমানে তাকে রাজধানীর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদর দপ্তরে নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে এখনো স্পষ্টভাবে কোনো মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, তার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সময় দায়ের হওয়া একটি গুরুতর মামলার অনুসন্ধান চলছে।
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজাহারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “নুসরাত ফারিয়াকে এখনো কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাচ্ছি। যাচাই করে দেখা হবে—তার বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় পরোয়ানা বা মামলার তথ্য রয়েছে কিনা। তারপরই সিদ্ধান্ত হবে, তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে কিনা।”
নুসরাত ফারিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ওই সময়কার সরকারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত একটি মামলায় তাকে অন্যতম আসামি হিসেবে নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালতে। মামলাটি দায়ের করেন এনামুল হক নামে এক নাগরিক, যিনি নিজেকে আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে দাবি করেছেন।
মামলার বিবরণীতে বলা হয়, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছাত্র ও যুবসমাজ রাজধানীজুড়ে একাধিক গণতান্ত্রিক দাবি নিয়ে বিক্ষোভে নামে। আন্দোলনের মূল দাবিগুলোর মধ্যে ছিল বৈষম্যমূলক নীতিমালার অবসান, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ, এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সেই সময় সরকারপন্থী শক্তিগুলো আন্দোলন দমনে শক্তি প্রয়োগ করে এবং এই দমন অভিযানে নুসরাত ফারিয়াসহ একাধিক ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
এনামুল হকের দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় একটি ছাত্রমিছিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় অন্য অভিযুক্তদের ছোড়া গুলিতে তার ডান পায়ে গুলি লাগে। তিনি তখন সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তার দাবি অনুযায়ী, এই সহিংস অভিযানে অর্থ জোগানদাতা হিসেবে ছিলেন নুসরাত ফারিয়া, যিনি শুধুমাত্র চলচ্চিত্র অঙ্গনের নয়, বরং তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
বর্তমানে গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধান চলবে তিনি আর্থিকভাবে কতটা জড়িত ছিলেন, এবং তিনি কীভাবে, কোথায় এবং কার মাধ্যমে এসব সহায়তা দিয়েছেন।
ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার এই প্রক্রিয়াকে অনেকে ‘প্রাথমিক তদন্তের অংশ’ বলেও অভিহিত করেছেন। আইনজীবীরা বলছেন, যেহেতু এখনো তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি, তাই এটি এখনো আটকের পর্যায়ে রয়েছে, তবে পরিস্থিতির পরিবর্তনে গ্রেপ্তারও হতে পারে।
নুসরাত ফারিয়া দীর্ঘদিন ধরেই একটি সফল মিডিয়া ক্যারিয়ার গড়েছেন। টিভি অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র ও সংগীত—তিন ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগের প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার কারণে তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ অনেক আগে থেকেই ছিল। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক বার তার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটেই তার বিরুদ্ধে মামলার ঘটনা ও গ্রেপ্তার সম্ভাবনা নতুন করে বিতর্ক তৈরি করছে। কেউ বলছেন, এটি হয়তো কোনো প্রতিহিংসার ফসল, আবার কেউ বলছেন—নুসরাত ফারিয়া কেবল একজন অভিনেত্রী নন, বরং তিনি নিজেই একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন, যার দায় তাকে বহন করতে হচ্ছে।
বর্তমানে নুসরাত ফারিয়া ডিবি হেফাজতে রয়েছেন। তাকে কোন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে, আদৌ কি করা হবে, কিংবা তাকে ছাড়া হবে কি না—সবকিছুই এখন নির্ভর করছে ডিবির তদন্তের ফলাফলের ওপর।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবস্থান যেমন শক্তিশালী, ঠিক তেমনিভাবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার নাম উঠে আসাও রাজনৈতিক উত্তেজনার একটি প্রতিচ্ছবি। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্তের পরই স্পষ্ট হবে—এটি কেবল একটি মামলার আইনি প্রক্রিয়া, নাকি বড় রাজনৈতিক হিসাবের শুরু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ