
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির সরকারি উদ্যোগ এবং এই উদ্দেশ্যে ঘোষিত অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে চলমান টানাপোড়েনের মধ্যে অবশেষে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ সামনে এসেছে। দেশের রাজস্ব প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মত হয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আগামী মঙ্গলবার, ২০ মে বিকেল সাড়ে তিনটায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে এই বহুল প্রত্যাশিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে নিশ্চিত করেছেন এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল আমিন শেখ।
এই আলোচনার সম্মতি অনেকেই দেখছেন এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে, যেখানে মাসব্যাপী অসন্তোষ, নানা কর্মসূচি এবং প্রশাসনিক অচলাবস্থার মধ্যে কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তারা আশার আলো খুঁজছেন।
সংকটের সূচনা: কীভাবে তৈরি হলো এনবিআর বিলুপ্তির পরিস্থিতি?
২০২৫ সালের মার্চ মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় হঠাৎ করে একটি খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করে, যার মূল প্রস্তাব ছিল ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে একটি নতুন স্বায়ত্তশাসিত রাজস্ব কর্তৃপক্ষ’ গঠন। সরকারি ভাষ্যে এটি ছিল একটি ‘সংগঠনতান্ত্রিক সংস্কার উদ্যোগ’, কিন্তু এনবিআরের অভ্যন্তরে এবং সংশ্লিষ্ট মহলে এটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, তাদের সঙ্গে কোনো রকম পূর্ব আলোচনায় না গিয়ে একতরফাভাবে এমন একটি গঠনমূলক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে যা দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তারা তিন দফা দাবি উপস্থাপন করেন:
১. এনবিআর বিলুপ্তির প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল,
২. রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারে অংশগ্রহণমূলক নীতিমালা প্রণয়ন,
৩. বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোয় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি-সহায়ক উন্নয়ন।
এর প্রেক্ষিতে এনবিআর চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের সংগঠন, অফিসারস অ্যাসোসিয়েশন, সহকারী কমিশনারদের ইউনিয়নসহ একাধিক সংগঠন একত্রিত হয়ে আন্দোলন শুরু করে। অবস্থান কর্মসূচি, কালো ব্যাজ ধারণ, প্রেস কনফারেন্স এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে কর্মকর্তারা জাতীয় রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রমে সীমিত আকারে কর্মবিরতি পালন করায় কর আদায়ের হার কমে যায় এবং বেশ কয়েকটি বন্দর ও কাস্টম হাউজে রাজস্ব প্রশাসনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
সরকারপক্ষের নীরবতা ও জনমত
আন্দোলনের সূচনার পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ সরকার পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না এলেও, বুদ্ধিজীবী মহল, সাবেক অর্থ সচিবরা এবং অর্থনীতিবিদদের একটি বড় অংশ এনবিআর বিলুপ্তির উদ্যোগের কঠোর সমালোচনা করেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খান (মরণোত্তর) স্মরণ সভায় বক্তারা এনবিআর’র গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “স্বাধীনতার পর এনবিআর দেশের অর্থনৈতিক ভিত গড়ার অন্যতম স্তম্ভ ছিল। এটি বিলুপ্ত করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে।”
এই প্রেক্ষাপটেই দেশের ভেতরে এবং প্রবাসী বাংলাদেশি রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যেও ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত: কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা?
এমন টানটান উত্তেজনার মধ্যে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের আলোচনায় বসার সম্মতি আন্দোলনকারীদের মধ্যে স্বস্তি এনেছে। তাঁর অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা তাঁকে এই সংকট সমাধানে একটি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এনবিআরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই আলোচনায় আমরা বাস্তবসম্মত সমাধানের পথ খুঁজে পেতে চাই। কোনো অবস্থানগত জেদের জায়গা থেকে নয়, বরং পেশাগত নীতিকতার জায়গা থেকে আমরা চাই এনবিআরের সংস্কার হোক যুক্তিযুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক।”
অর্থ উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে যে আলোচনায় তিন দফা দাবিসহ আন্দোলনকারীদের উদ্বেগ শোনা হবে এবং প্রয়োজনে অধ্যাদেশের খসড়া পেছানো বা পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মত
অর্থনীতি ও রাজস্ব শাসনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা অবশ্যই জরুরি, তবে তা হতে হবে টেকসই পরিকল্পনার ভিত্তিতে এবং সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্ত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ তৌহিদ হাসান বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি 'সংস্কার' শব্দটি ব্যবহৃত হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে। এনবিআর একটি চমৎকার প্রতিষ্ঠান, যার ভেতর থেকেই দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—মঙ্গলবারের আলোচনায় আদৌ কোনো সমঝোতা হবে কিনা। এনবিআরের ৩২ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন তাকিয়ে আছেন এ বৈঠকের দিকে। একটি দীর্ঘস্থায়ী, অংশগ্রহণমূলক এবং পেশাভিত্তিক সমাধান যদি এই বৈঠক থেকে আসে, তাহলে তা দেশের রাজস্ব শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।
সরকারের তরফ থেকেও বার্তা এসেছে যে, সরকার জনস্বার্থে কোনো আলোচনায় পিছপা হবে না। তবে রাজনৈতিক মহলের একটি অংশ মনে করছে, এনবিআর বিলুপ্তি পরিকল্পনার পেছনে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে পুনর্বিন্যাসের গোপন অভিপ্রায় রয়েছে, যা নিয়ে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিতর্ক আরও বাড়তে পারে।
তবে আপাতত সবার নজর ২০ মে বিকেলের আলোচনায়। এনবিআরের ভবিষ্যৎ, রাজস্ব ব্যবস্থার গতি এবং হাজার হাজার কর্মকর্তার পেশাগত স্থিতিশীলতা—সব কিছুর ভাগ্য নির্ধারিত হতে পারে এই এক বৈঠকে।
বাংলাবার্তা/এসজে