
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গজিয়ে ওঠা সিসা লাউঞ্জগুলোকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে একটি অন্ধকার জগত—যেখানে তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ, বিদেশি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা, এবং প্রভাবশালীদের ছায়া যেন এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরছে। এই বাস্তবতা প্রকাশ্যে আসে গত বৃহস্পতিবার রাতের বিশেষ অভিযানকে কেন্দ্র করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) এর মহাপরিচালক হাসান মারুফের নেতৃত্বে চালানো এই ‘সাঁড়াশি অভিযান’ রাজধানীর বনানীতে সিসা সেবনের আড়ালে চলা মাদক কারবারের ভয়ঙ্কর বিস্তারকে নগ্নভাবে উন্মোচন করেছে।
অভিযান: তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকলেই তরুণ-তরুণীদের মাতাল আসর
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি বনানীর ১১ নম্বর রোডের ‘হেইজ’ এবং ‘সিগনেচার লাউঞ্জ’ নামের দুটি সিসা লাউঞ্জে চলা এই অভিযানে নারকোটিক্সের মহাপরিচালক থেকে শুরু করে ডিআইজি, পরিচালক, সহকারী পরিচালকসহ অন্তত ৩৫ জন কর্মকর্তা অংশ নেন। প্রথমে ‘হেইজ’ লাউঞ্জে প্রবেশ করতে গেলে দেখা যায়, বাইরে থেকে ফটক তালাবদ্ধ। সেখানেই প্রথম বিস্ময়ের সূচনা—তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে কর্মকর্তারা দেখেন, শতাধিক তরুণ-তরুণী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় লাউঞ্জে সময় কাটাচ্ছেন।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ছিল নিকষ অন্ধকার। তরুণীরা বসে আছে ঘরে ঘরে, অনেকেই মদ্যপ অবস্থায়। পেছনের একটি রুমে কয়েকজন বিদেশি নাগরিককে সিসা টানতে দেখা যায়।”
এই বিদেশিরা নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রথমে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, এমনকি অভিযানের সদস্যদের দিকে মারমুখী আচরণ করেন বলেও জানান উপস্থিত কর্মকর্তারা।
‘দূতাবাসের পরিচয় দিয়ে বাঁচার চেষ্টা’, তদন্ত চায় বিশেষজ্ঞরা
জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) কামরুল হাসান বলেন, “যদি সত্যিই বিদেশি দূতাবাসের পরিচয় দিয়ে কেউ মাদকাসক্তির পরিবেশে ধরা পড়ে, এটি ভয়াবহ কূটনৈতিক জটিলতা ডেকে আনতে পারে। সরকারকে অবশ্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্ত করতে হবে তারা সত্যিই দূতাবাস কর্মকর্তা কি না, এবং যদি হন, তাদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হবে কি না।”
হেইজ লাউঞ্জের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা, ধরা পড়েছে ২ জন
‘হেইজ’ লাউঞ্জের বিরুদ্ধে বনানী থানায় ১২ জন মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন কাজী মোহাম্মদ সামি, নাজমুল সাকিল, চৌধুরী গোলাম আনাস, মুফরাত হাসান ওরফে বান্টি, আল রহমান, সাদমান হোসেন, সাকিব হোসেন, সৈয়দ মুহাম্মদ তাহমিদ আহসান এবং আহমেদ মোস্তফা ওরফে রাসেল।
এ ছাড়া লাউঞ্জের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম ওরফে জসিম এবং ইমরান হোসেনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানকালে উদ্ধার করা হয় ২৬টি হুঁকা, সাত কেজি উচ্চমাত্রার আমদানি নিষিদ্ধ সিসা এবং বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ।
আরেকটি অভিযানে ধরা পড়ে আরও ৪ জন, একজন পলাতক
একই রাতে বনানী ১১ নম্বর রোডের ৫০ নম্বর বাড়ির ১৩ তলায় ‘সিগনেচার লাউঞ্জ’-এ চালানো অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় স্বপন মিয়া, শাকিল, সিয়াম ও আ. রায়হান নামের চারজনকে। পলাতক রয়েছেন তারেক জামিল। লাউঞ্জটি থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচ কেজি সিসা, ২০টি হুঁকা এবং বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ।
‘হেইজ’ ছিল রাজধানীর সবচেয়ে কুখ্যাত সিসা লাউঞ্জ: নারকোটিক্স
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, হেইজ দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর অন্যতম প্রভাবশালী ও কুখ্যাত সিসা লাউঞ্জ হিসাবে পরিচিত। প্রভাবশালী পৃষ্ঠপোষকতার কারণে এতদিন আইন প্রয়োগকারীরা চুপচাপ ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কড়া নির্দেশনার পর এই অভিযান পরিচালিত হয়।
অভিযানের পরই গুলশান ও বনানীর অনেক পরিচিত মাদক ব্যবসায়ী এলাকা ছাড়তে শুরু করেন। কিছু লাউঞ্জ মালিক তাৎক্ষণিকভাবে আস্তানা গুটিয়ে পালিয়ে যান।
সিসা কি মাদক?—বৈজ্ঞানিক ও আইনি দিক
ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, “সিসায় দুই শতাংশের বেশি নিকোটিন পাওয়া গেলে তা আইন অনুযায়ী মাদক হিসাবে গণ্য হয়। অথচ রাজধানীর অধিকাংশ লাউঞ্জে ব্যবহৃত সিসার নিকোটিন মাত্রা গড়ে পাঁচ থেকে সাত শতাংশের মধ্যে। এটি তরুণদের ফুসফুস ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক বিকারও তৈরি করছে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লুৎফর রহমান বলেন, “সিসা টানার ফলে ফুসফুসে কার্বন মনোক্সাইড ও ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান জমা হয়। ধোঁয়াটে পরিবেশে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ফলে হৃদরোগ, নিউমোনিয়া, এমনকি মানসিক অবসাদ পর্যন্ত হতে পারে।”
আইন কী বলছে? নারকোটিক্সের বক্তব্য
নারকোটিক্সের অতিরিক্ত পরিচালক একেএম শওকত ইসলাম বলেন, “বর্তমান আইনে উচ্চমাত্রার নিকোটিনসহ সিসা পরিবেশন স্পষ্টতই অপরাধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া নির্দেশনায় এসব লাউঞ্জের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতিতে অভিযান চালানোর স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের অভিযান চলমান থাকবে। আমরা লক্ষ্য করছি, এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে কিছু প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, যারা লাউঞ্জগুলোকে রক্ষা করতে চায়। তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
সিসা কাণ্ডের পর প্রশ্ন: এতদিন কে বা কারা রক্ষা করছিল এই ব্যবসা?
অভিযানের পর সর্বত্র প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন ধরে এইসব লাউঞ্জ কীভাবে বুক ফুলিয়ে ব্যবসা চালিয়ে গেছে? কে বা কারা তাদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করছিল? কেন আগের অভিযানগুলো ছিল লোক দেখানো?
আইন ও অপরাধ বিশ্লেষক ব্যারিস্টার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এখানে সুশাসনের ঘাটতি পরিষ্কার। যদি এতদিন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে বুঝতে হবে, প্রশাসনের কোনো অংশ হয়তো মদত দিচ্ছিল। স্বচ্ছ তদন্ত ছাড়া আসল পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।”
সময় এসেছে কঠোর নজরদারির
এই অভিযান শুধু সিসা লাউঞ্জ নয়, বরং রাজধানীর তরুণ প্রজন্মের ধ্বংসের পেছনে থাকা অজানা কারিগরদের মুখোশ উন্মোচনের প্রথম ধাপ হতে পারে। তবে যদি এই অভিযানও পূর্বের মতো কিছুদিনের মধ্যে স্তিমিত হয়ে যায়, তাহলে আবারও এই অন্ধকার গহ্বরে ফিরে যাবে শত শত তরুণ-তরুণী।
এখন সময় এসেছে একযোগে আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা, এবং কূটনৈতিক বাস্তবতার সমন্বয়ে সিসা লাউঞ্জ নামক এই আধুনিক মাদক জগতকে নিশ্চিহ্ন করার। সিসা লাউঞ্জের আড়ালে যেন না জন্ম নেয় আরেকটি প্রজন্ম ধ্বংসের যন্ত্র।
বাংলাবার্তা/এসজে