
ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা আশঙ্কাজনক মোড় নিচ্ছে। কাশ্মীরের পহেলগাঁও এলাকায় ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার জেরে নয়টি পৃথক স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভূপাতিত করেছে ভারতের একাধিক ড্রোন ও যুদ্ধবিমান বলে দাবি করেছে। ক্রমবর্ধমান এই সংঘাতের জেরে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, বিশ্ব এই অঞ্চলের দুটি প্রতিবেশী দেশের যুদ্ধের ভার বহন করতে পারবে না।
গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগাঁও এলাকায় একদল বন্দুকধারীর হামলায় প্রাণ হারায় ২৬ জন নিরীহ মানুষ। এ ঘটনার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং তার জবাবে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দাবি, তারা "সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি" লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
তবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব হামলায় নিরীহ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও আহত হয়েছেন। দেশটির জিও নিউজ এবং ডন টিভি’র সূত্রে জানা গেছে, হামলায় নারী ও শিশুরাও হতাহত হয়েছেন, যার ফলে পুরো পাকিস্তানে চরম ক্ষোভ এবং প্রতিশোধস্পৃহা তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র এক বিবৃতিতে দাবি করেন, ভারতের হামলার পর তারা দ্রুত পাল্টা জবাব দেয়। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী ভারতের বেশ কয়েকটি ড্রোন ও যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। কিছু সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের সামরিক চৌকিতেও পাল্টা হামলা চালানো হয়েছে।
এই পাল্টা প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে এবং দেশজুড়ে ব্যাপক দেশাত্মবোধক স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছে বিভিন্ন শহর। সরকার বলছে, তাদের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের আগ্রাসন হলে তা কঠিনভাবে প্রতিহত করা হবে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মুখপাত্র স্টেফানি ট্রাম্বলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দক্ষিণ এশিয়ার দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত শুধু এই অঞ্চল নয়, গোটা বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক। বিশ্ব এই সংঘাতের ভার বহন করতে পারবে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি এবং সংলাপ ও কূটনৈতিক উপায়ে সংকট সমাধানের তাগিদ দিচ্ছি। জাতিসংঘ সংঘর্ষ নয়, শান্তির পক্ষে দাঁড়ায়।”
উত্তেজনা বাড়ার ফলে উভয় দেশই তাদের বিমান চলাচলে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাকিস্তানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর—লাহোর, শিয়ালকোট ও করাচি—সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে সাময়িক এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে।
অন্যদিকে, ভারতও কম যায়নি। দেশটির উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত ২১টি বিমানবন্দর আগামী ১০ মে ভোর ৫টা ২৯ মিনিট পর্যন্ত যাত্রীবাহী ফ্লাইটের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। ভারতীয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (ডিজিসিএ) জানায়, “এনওটিএএম” জারি করে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায় সম্ভাব্য নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলার অংশ হিসেবে।
এই সাম্প্রতিক হামলা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মহলেও উদ্বেগের মাত্রা বাড়ছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংঘাত যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তা শুধু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ অগ্রগতিও থমকে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধ নয়, এই মুহূর্তে উভয় পক্ষের উচিত দ্রুত কূটনৈতিক স্তরে যোগাযোগ শুরু করা এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক গঠনগুলোর মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমন করা।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার বর্তমান উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক সংকটপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ ও সাম্প্রতিক রক্তক্ষয়ী ঘটনাগুলো পারমাণবিক সংঘাতের আশঙ্কাও বাড়িয়ে তুলেছে। জাতিসংঘের সংযমের আহ্বান একে গুরুত্বের সাথে না নিলে এই সংঘাত বৃহত্তর মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য দুই দেশের নেতাদের এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হলো—আগ্রাসনের পথ পরিহার করে শান্তি ও আলোচনার পথ বেছে নেওয়া।
বাংলাবার্তা/এমএইচ