ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জীবনদানকারী শহীদ এবং অঙ্গহানি বা গুরুতর আহতদের পরিবারের জন্য দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন কল্যাণমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। মিরপুরে নির্মিতব্য দুটি আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে এই শহীদ ও চূড়ান্তভাবে অক্ষম আহতদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি দেওয়া হবে আজীবন চিকিৎসা, আর্থিক অনুদান এবং পুনর্বাসনের বিভিন্ন সুবিধা।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুরে দুটি আবাসন প্রকল্পের অধীনে ১৪০০ থেকে ১৫০০টি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শহীদ পরিবারকে ১২৫০ বর্গফুট এবং ‘ক্যাটাগরি-এ’ চূড়ান্তভাবে অক্ষম আহতদের জন্য ১০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই দুটি প্রকল্পের একটি গড়ে উঠবে মিরপুর-১৪ নম্বর সেক্টরে পুলিশ স্টাফ কলেজের উল্টো পাশে, অপরটি মিরপুর-৯ নম্বর এলাকার পল্লবী থানার পেছনে।
প্রতিটি ফ্ল্যাট সমন্বিত নাগরিক সুবিধা সহকারে নির্মিত হবে। প্রকল্প এলাকায় থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, সড়ক, পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা। দু’বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজটি বাস্তবায়ন করবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় প্রাথমিকভাবে দুই হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও বিভিন্ন অবকাঠামোগত সহযোগিতা অন্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়ায় ব্যয় কমে আসবে। ব্যয় সংক্রান্ত বিষয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই শ্রেণিবিন্যাস করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যৌথভাবে।
‘ক’ শ্রেণি (অতি গুরুতর আহত):
-
যাঁরা উভয় হাত/পা হারিয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়েছেন, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন বা স্বাভাবিক কাজ করার সম্পূর্ণ অক্ষম হয়েছেন।
-
এককালীন অনুদান: ৫ লাখ টাকা।
-
মাসিক ভাতা: ২০ হাজার টাকা।
-
আবাসন সুবিধা: ১০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট।
-
আজীবন চিকিৎসা সেবা।
‘খ’ শ্রেণি (মাঝারি মাত্রার আহত):
-
একটি অঙ্গ হারিয়েছেন বা আংশিক অক্ষম।
-
এককালীন অনুদান: ৩ লাখ টাকা।
-
মাসিক ভাতা: ১৫ হাজার টাকা।
-
চিকিৎসা সেবা অব্যাহত থাকবে।
‘গ’ শ্রেণি (সামান্য আহত):
-
চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
-
ভাতা প্রাপ্য নন।
-
সরকারি চাকরি ও পুনর্বাসন কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার।
শহীদ পরিবারকে ইতোমধ্যে আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে এবং আগামী অর্থবছরে আরও ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। মোট ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র শহীদ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকার ৮৩৪ জন শহীদের নামের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে। আহতদের মধ্যে ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ শ্রেণিতে আলাদা আলাদা তালিকা প্রকাশ করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘ক’ শ্রেণির ৪৯৩ জন গুরুতর আহতের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ তালিকায় প্রত্যেক আহত ব্যক্তির নাম, পিতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা, মেডিকেল কেস আইডি এবং গেজেট নম্বর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অনুবিভাগ-১) মো. আব্দুল মতিন জানান, “জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও গুরুতর আহতদের কীভাবে সর্বোচ্চ সম্মান ও সহায়তা দেওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে আমরা একটি প্রস্তাবনা হাতে নিয়েছি। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে প্রস্তাব দিয়েছে, যা মন্ত্রণালয় ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে।”
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. নুরুল বাসির বলেন, “এটি নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পেলেই আমরা প্রকল্প চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করব। শহীদ ও গুরুতর আহতদের জন্য কিছু করা নৈতিকভাবে আমাদের দায়িত্ব।”
এছাড়া গত ৪ মে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় প্রকল্প এলাকার ভেতরে প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম। এর আগে মন্ত্রণালয় নিজেদের অভ্যন্তরীণ বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা করে।
সরকারের এই উদ্যোগ শুধু শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসনের দৃষ্টান্তই নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক জনআন্দোলনের প্রতি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব পালনের নিদর্শনও। প্রস্তাবিত প্রকল্প এবং সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধাগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগ রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণ মর্যাদায় স্বীকৃতি পাবে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তব রূপ প্রকাশ পাবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



