
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর শহরের ওয়ালটন রোড এলাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একাধিক শক্তিশালী বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পরপর দুটি থেকে তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়, যা বিস্তীর্ণ এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করেই প্রচণ্ড শব্দে কম্পিত হয় ওয়ালটন রোডের একাংশ। এলাকার বহু বাসিন্দা নিজেদের জীবন বাঁচাতে রাস্তায় নেমে আসেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ধোঁয়ার ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতে থাকেন।
পাকিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশেষ কম্ব্যাট ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় এবং বিস্ফোরণস্থলের আশপাশের অন্তত এক কিলোমিটার এলাকা ঘিরে ফেলে। পুলিশের সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট (CTD) এবং সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ স্কোয়াড ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে।
লাহোর পুলিশ চিফ উমর শেখ সাংবাদিকদের জানান, “বিস্ফোরণের উৎস এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আমরা এলাকাটিকে ক্লিয়ার করছি। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট তল্লাশি চালাচ্ছে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না তবে নিরাপত্তা সতর্কতা সর্বোচ্চ মাত্রায় উন্নীত করা হয়েছে।”
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিস্ফোরণের পরপরই সড়কে ভেঙে পড়া দেয়াল, ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি ও একটি দোকানের ধোঁয়া উঠছে। এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
আন্তরিকভাবে প্রশাসন এখনো বিস্ফোরণের প্রকৃতি সম্পর্কে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঘটনাটি সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে বলে তারা সন্দেহ করছেন। কিছু অবিস্ফোরিত ডিভাইস উদ্ধারের কথাও বলা হচ্ছে।
পাঞ্জাব প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেন, “লাহোর শহর বহুবার জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। তাই আমরা সব সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছি। ওয়ালটন এলাকায় একটি বিস্ফোরণ নয়, একাধিক বিস্ফোরণ হয়েছে—এটি নিশ্চিত। কারা এর পেছনে, সেটা এখনো বলা যাচ্ছে না।”
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফআইএ এবং আইএসআই কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন বলে জানা গেছে।
এই বিস্ফোরণ এমন এক সময় ঘটল, যখন পুরো পাকিস্তানজুড়ে যুদ্ধাবস্থার প্রস্তুতি চলছে। মাত্র একদিন আগেই কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে ভারত পাকিস্তানের কমপক্ষে ৯টি স্থানে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালিয়েছে বলে দাবি করে। ভারতীয় মিডিয়ায় জানানো হয়, ২৪টি সামরিক ও জঙ্গি সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় হামলা করা হয়েছে।
এর জবাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ শাখা আইএসপিআর দাবি করেছে, “আমরা ভারতের একটি ব্রিগেড সদর দফতর, ২টি গোলাবারুদ ঘাঁটি এবং ৩টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় পাল্টা আক্রমণ চালিয়েছি। এতে অন্তত ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান, একটি ড্রোন ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের তৈরি ৩টি রাফাল, একটি মিগ-২৯ ও একটি এসইউ-৩০।”
ফ্রান্সের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রও অন্তত একটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
এই যুদ্ধঘোষণা ও পাল্টা জবাবের ঠিক একদিন পরেই লাহোরে এমন বিস্ফোরণ, সেটিকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছে না অনেক বিশ্লেষক।
সামরিক বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) আমজাদ হাসান বলেন, “বিস্ফোরণের ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সময়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটি হতে পারে প্রতিশোধমূলক হামলা অথবা শত্রুপক্ষের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা। ওয়ালটন একটি সেনাঘাঁটির খুব কাছাকাছি, যা এই বিস্ফোরণকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।”
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খার বলেন, “যুদ্ধের সময় অনেক সময় ভেতরের কিছু শক্তি, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার প্ররোচনায় এমন হামলা হয়, যাতে জনগণের মনে আরও ভীতির সঞ্চার হয় এবং যুদ্ধ সমর্থন বেড়ে যায়। সরকারকে এখন সতর্ক থাকতে হবে এই প্ররোচনার বিরুদ্ধে।”
লাহোরের বিস্ফোরণের খবর বাংলাদেশেও আলোড়ন তুলেছে। যুদ্ধের শঙ্কা এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যেই এমন বিস্ফোরণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, “এটি নিছক বিস্ফোরণ নয়, এটি একটি বার্তা। ভারত-পাকিস্তানের বর্তমান উত্তেজনার মধ্যে এমন ঘটনা গোটা অঞ্চলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশকেও সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনো ধরনের উসকানি আমাদের সীমান্তেও না ছড়িয়ে পড়ে।”
লাহোরের এই বিস্ফোরণ কেবল একটি শহরের নিরাপত্তা বিঘ্ন নয়, এটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতির জটিলতাকেই সামনে নিয়ে আসছে। যুদ্ধ আর কূটনীতি এখন একে অপরকে ছায়া দিচ্ছে। বিস্ফোরণের প্রকৃতি স্পষ্ট না হলেও, একে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও প্রশাসন বলছে, তদন্ত শেষ হলেই বিস্তারিত জানানো হবে। কিন্তু ততক্ষণে লাহোর শহর জুড়ে মানুষের মনে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে—তা কি সহজে মোছা যাবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ