
ছবি: সংগৃহীত
উপমহাদেশের দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এক বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে মাত্র ২৫ মিনিটে পাকিস্তানের অভ্যন্তর ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের অন্তত নয়টি স্থাপনায় ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এই হামলায় ৭০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে বলে দাবি করছে ভারত। অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, প্রাণহানির সংখ্যা ২৬। ভারতের এই সামরিক অভিযানের নাম— ‘অপারেশন সিঁদুর’।
পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডের পাল্টা প্রতিক্রিয়া
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বুধবার সকালে দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “অপারেশন সিঁদুর ছিল ভারতের একটি সমানুপাতিক ও দায়িত্বশীল প্রত্যাঘাত, যা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না।” তিনি আরও জানান, পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকেই ভারত এ ধরনের একটি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই হামলার দায় কোনো পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও ভারত বিশ্বাস করে, পাকিস্তানের মাটিতে অবস্থান করা জঙ্গি সংগঠনগুলোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
সামরিক অভিযান: পরিকল্পনা ও টার্গেট
ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর দুই নারী কর্মকর্তা— কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। এই দুই কর্মকর্তা জানান, মঙ্গলবার রাত ১টা ৫ মিনিট থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) এবং আন্তর্জাতিক সীমানার ওপারে নির্দিষ্ট ৯টি টার্গেটকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
তারা জানান, এই অভিযানে কোনো পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটি কিংবা বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু ছিল না। বরং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোকে নিশানা করা হয়েছে যাতে কোনো সাধারণ নাগরিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
সোফিয়া কুরেশি বলেন, “এই হামলা ছিল স্পষ্টভাবে প্রতিশোধমূলক এবং প্রতিরোধমূলক। আমরা বেছে বেছে টার্গেট করেছি সেসব স্থাপনাকে যেগুলো থেকে ভারতে জঙ্গি অনুপ্রবেশ ও হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল।”
কোন কোন ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে?
ব্রিফিংয়ে দেখানো হয় হামলায় ধ্বংস হওয়া বিভিন্ন ঘাঁটির স্যাটেলাইট ছবি। কর্মকর্তারা জানান, অভিযান চালানো হয়েছে ভাওয়ালপুরের মারকাজ শুবহান আল্লাহ্ নামক একটি শিবিরে, যেটি জইশ-এ-মহম্মদের প্রধান প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। একইভাবে বিলাল মসজিদে লস্কর-ই-তাইয়েবা পরিচালিত একটি ঘাঁটি টার্গেট করা হয়।
এছাড়া পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের কোটলি এলাকায় লস্করের আরেকটি ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়, যেখানে পুঞ্চ অঞ্চলে হামলার জন্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার বিস্তৃতি
ভারতীয় কর্মকর্তারা জানান, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিও হামলার আওতায় এসেছে। শিয়ালকোটের সার্জাল ক্যাম্প, যা আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে ৬ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত, ছিল অপারেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এখানে হিজবুল মুজাহিদিনের জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, যারা পেহেলগামে সাম্প্রতিক হামলায় অংশ নেয় বলে ধারণা।
একইভাবে মেহমুনা জোয়া ক্যাম্পেও হামলা চালানো হয়, যেখানে হিজবুলের অভিজাত ইউনিট প্রশিক্ষণ গ্রহণ করত। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয় লাহোরের কাছে মুরিদকের মারকাজ তৈয়্যেবা ঘাঁটিকে, যেখান থেকেই ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলায় অংশ নেওয়া আজমল কাসভসহ অন্যান্য জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক বার্তা
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, “এই প্রতিক্রিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২৫ এপ্রিলের বিবৃতির আলোকে এসেছে। সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, পেহেলগামের হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ভারত এই বিবৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে তার স্বার্থ রক্ষা করেছে।”
অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার ভারতকে অভিযুক্ত করে বলেছে, তারা বেসামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। তবে ভারতীয় বাহিনী বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের প্রত্যাঘাত অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ও নিরপেক্ষ ছিল।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: চরম উত্তেজনার মুখে
গত কয়েকদিন ধরেই উপত্যকায় যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছিল। দুই দেশের সীমান্তে মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত সেনা ও গোলাবারুদ। সীমান্ত অঞ্চলে বেসামরিক বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশও জারি করা হয়েছিল।
এই হামলার পর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি হতে পারে সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সংঘাতগুলোর একটি। যদিও এখনো সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা আসেনি, তবে উভয় পক্ষই যুদ্ধের আশঙ্কায় প্রস্তুতি নিচ্ছে। কূটনৈতিক মহলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে ভারত শুধু প্রতিশোধই নেয়নি, বরং এটি পাকিস্তানকে একটি কৌশলগত বার্তা দিয়েছে যে—ভারত এখন আর কূটনৈতিক শিষ্টাচারেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং প্রয়োজন হলে সরাসরি সামরিক প্রতিক্রিয়াও দেবে। এখন দেখার বিষয়, পাকিস্তান এর প্রতিক্রিয়ায় কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
চরম উত্তেজনার এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান ছাড়া উপমহাদেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের এই নতুন মোড় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ