
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত একদলীয় শাসনের পর দেশের দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়ায় নতুন গতি এসেছে। দেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত রাজনৈতিক চরিত্র ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এবার সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে একটি উচ্চমূল্যের বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তের অংশ হিসেবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার, ৮ মে, কমিশনে হাজির হতে বলা হয়েছে।
দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে ৫ মে পাঠানো একটি তলবি চিঠিতে শেখ হাসিনাসহ আরো দু’জন গুরুত্বপূর্ণ সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৯ থেকে ২০২4 সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
এ সময় দেশজুড়ে বিমান চলাচল ও পরিবহন খাতে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়—এর মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কক্সবাজার বিমানবন্দরের রিডিজাইন, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ এবং সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরের আধুনিকীকরণ প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, এসব প্রকল্পে সীমাহীন ব্যয় বৃদ্ধির আড়ালে ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। পরিকল্পনার তুলনায় একাধিক প্রকল্পে ব্যয় তিন থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়েছে, অথচ বাস্তব অগ্রগতি ছিল অনুপাতিক নয়।
দুদক চিঠিতে যেসব নাম উঠে এসেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন—
-
শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনদাতা।
-
মো. মাহবুব আলী, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বর্তমানে দুর্নীতির আরেক মামলায় গ্রেফতার।
-
মোকাম্মেল হক, বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, যিনি বর্তমানে 'পলাতক' হিসেবে চিহ্নিত।
দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শেখ হাসিনাকে তলবপত্র পাঠানো হয়েছে ধানমন্ডির সুধাসদন ও তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। অন্যদিকে, মোকাম্মেল হক ও মাহবুব আলীর চিঠি যথাক্রমে তাদের শহর ও গ্রামের ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে।
দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকলেও তদন্তের স্বার্থে কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। যদি কেউ দোষী না হন, তা তদন্তেই প্রমাণিত হবে। কিন্তু তলব করা মানেই আমরা প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য পেয়েছি।”
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বর্তমানে ভারতে রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তার রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি এখনও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি, তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এক ‘নিরাপদ জায়গায়’ তাকে রাখা হয়েছে।
সাবেক সচিব মোকাম্মেল হক সম্পর্কে একটি সূত্র জানায়, সরকারি দল পরিবর্তনের পর থেকে তিনি দেশত্যাগ করেছেন এবং বর্তমানে মালয়েশিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) আতিক রহমান বলেন, “দুদকের এমন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে সাহসী এবং এটি প্রমাণ করে যে, এই সংস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কাজ করছে।”
অন্যদিকে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। এ ধরনের তলব রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আদালত এবং তদন্ত সংস্থাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ এই প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলীপ সরকার বলেন, “বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন সাবেক ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীকে এমন সরাসরি দুর্নীতির জবাবদিহিতে তলব করা হলো। এটা বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতার একটি পরীক্ষাও বটে।”
এদিকে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এই বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে তাদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, “দুদক মূলত একটি পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনাকে হয়রানি করছে। এসব ভিত্তিহীন অভিযোগে তাকে নাজেহাল করা হচ্ছে।”
আগামীকাল বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা দুদকে হাজির হবেন কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তবে দুদক জানিয়েছে, অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যার মধ্যে আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও থাকতে পারে।
সাবেক সরকারের শীর্ষপর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এই তদন্ত শুধু শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি নয়, বরং গোটা রাজনীতির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কাঠামোকে নতুন করে নিরীক্ষণের সুযোগ এনে দিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ