
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই দীর্ঘ ছুটি ঘোষণার ফলে সরকারি অফিস, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। তবে জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় জরুরি কার্যক্রম নিশ্চিত করতে বেশ কিছু খাত এই ছুটির আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
বুধবার (৭ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বিস্তারিত সিদ্ধান্ত জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনসাধারণের নির্বিঘ্নে ঈদযাত্রা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে ১১ ও ১২ জুন (বুধবার ও বৃহস্পতিবার) নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি টানা ছুটি নিশ্চিত করতে আগের ও পরের দিনসহ মোট ১০ দিনের ছুটির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে এই দীর্ঘ ছুটির ফলে যাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ব্যাহত না হয়, সে জন্য কিছু সংস্থা ও সেবা প্রতিষ্ঠানকে ছুটির আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি সরবরাহ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবা, ডাকঘরের কার্যক্রম এবং এসব সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যানবাহন ও জনবল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জনস্বার্থে স্বাস্থ্যখাত—বিশেষ করে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা—এই ছুটির সময়ও পুরোদমে চালু থাকবে। চিকিৎসা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত চিকিৎসক, নার্স, হাসপাতাল কর্মী এবং অ্যাম্বুলেন্সসহ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বহনকারী যানবাহন এই ছুটির আওতার বাইরে থাকবে।
বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অতিরিক্ত জনবল ও প্রস্তুতির মাধ্যমে ছুটি চলাকালীন সময়েও চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, “ঈদের সময় সবসময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আলাদা ওয়ার্ড এবং স্ট্যান্ডবাই চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়। এবারও সে রকম প্রস্তুতি চলছে।”
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রম চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। অর্থাৎ দেশের আর্থিক লেনদেন যাতে ছুটির প্রভাব থেকে রক্ষা পায়, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “ঈদের সময় ব্যবসায়িক লেনদেন, রেমিট্যান্স গ্রহণ, এটিএম ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে আমরা কিছু নির্ধারিত দিনে কিছু ব্যাংক খোলা রাখার পরিকল্পনা করছি। এ বিষয়ে শিগগিরই বিজ্ঞপ্তি আসবে।”
এদিকে আদালতের কার্যক্রম নিয়েও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সুপ্রিম কোর্ট তার নিজস্ব প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে প্রয়োজন অনুযায়ী বিচার কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অতীতে যেমন ঈদের আগে ও পরে জরুরি বেঞ্চ খোলা রাখা হতো, এবারও তেমন প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক কর্মকর্তা।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, ছুটি দীর্ঘ হলেও দাপ্তরিক কার্যক্রম সচল রাখতে ঈদের আগের দুই শনিবার অর্থাৎ ১৭ মে ও ২৪ মে অফিস খোলা রাখা হবে। এই দিনে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। সাধারণত শনিবার সপ্তাহান্তে ছুটি থাকলেও এবার ওই দুটি দিন অফিস চলবে।
এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ঈদের আগের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি ও কাজগুলো সম্পন্ন করা সহজ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে বাজেট প্রস্তুতি, উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি ও জরুরি ফাইল নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এই দিনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
দেশের বড় বড় বন্দর যেমন চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর, পেট্রোল পাম্প, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জ্বালানি সরবরাহ কার্যক্রমও চালু থাকবে। কারণ ঈদের সময় পশু কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ফরিদ উদ্দিন বলেন, “আমরা ঈদের ছুটিতেও ২৪ ঘণ্টার বর্জ্য অপসারণের পরিকল্পনা করি। সেজন্য ঈদের সময় আমাদের কর্মীরা ছুটি পান না। তারা তিন ধাপে কাজ করেন, যেন শহর পরিষ্কার থাকে।”
সরকারের এই সিদ্ধান্তে একদিকে কর্মজীবীরা যেমন দীর্ঘ ছুটির সুযোগ পাচ্ছেন, অন্যদিকে জনসাধারণও নিশ্চিত হচ্ছেন যে জরুরি ও প্রয়োজনীয় সেবা বন্ধ হবে না। বিশেষত স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস ও যোগাযোগব্যবস্থার মতো খাত সচল থাকায় ঈদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, “লম্বা ছুটিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় চিকিৎসা ও ইন্টারনেট। এবার যেহেতু তা বন্ধ থাকছে না, তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি।”
অন্তর্বর্তী সরকারের এই দীর্ঘ ছুটির সিদ্ধান্ত দেশজুড়ে আনন্দ ও প্রস্তুতির আবহ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ও প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখার পদক্ষেপ জনগণের মৌলিক প্রয়োজন ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে একটি পরিপূর্ণ ভারসাম্য স্থাপন করেছে। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসনিক পর্যায়ে এই ছুটিকালীন ব্যবস্থাপনার বাস্তব রূপ কতটা কার্যকর হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ