
ছবি: সংগৃহীত
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে কাশ্মীর সীমান্তে সাম্প্রতিক সামরিক অভিযানের পর। মঙ্গলবার (৬ মে) গভীর রাতে ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালায়। এর জবাবে পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এই সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ২৬ জন নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী, আহত হয়েছে অন্তত ৪৬ জন।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই হামলা ছিল “নির্ভুল ও লক্ষ্যভিত্তিক।” তাদের দাবি অনুযায়ী, নয়টি ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো’ ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানভিত্তিক দুটি কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন—জইশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তাইয়্যেবা—এর কার্যক্রম পরিচালনাকারী কেন্দ্র। এই দুটি গোষ্ঠীকে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যেই সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রতি হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি বাসে বোমা হামলায় ২৬ জন ভারতীয় নিহত হন। সেই হামলার পেছনে এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করে ভারত। সেই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবেই এই বিমান হামলা পরিচালিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
হামলার ঘটনার পর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ভারতীয় বিমান হামলা আমাদের সার্বভৌমত্বের সরাসরি লঙ্ঘন। আমাদের সীমান্তের ভেতর ছয়টি ভিন্ন স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। আমরা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবহিত করেছি এবং জানিয়ে দিয়েছি, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক আইন মেনে তার অবস্থান পরিষ্কার করবে। তবে আমাদের সম্মান ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যা কিছু প্রয়োজন, আমরা তা করতে বাধ্য হবো।”
পাকিস্তান আরও দাবি করেছে, তারা ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। যদিও ভারত এখনো এ ধরনের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চারটি পৃথক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, অন্তত তিনটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান পৃথক স্থানে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং তাদের পাইলটদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, “আমরা লক্ষ্যবস্তু বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সংযম দেখিয়েছি এবং বেসামরিক কোনো এলাকায় হামলা চালানো হয়নি। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসের অবকাঠামো ধ্বংস করা, যাতে ভবিষ্যতে ভারতে এমন হামলা না হয়।”
অন্যদিকে পাকিস্তান বলছে, ভারত মিথ্যা প্রপাগান্ডার মাধ্যমে আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ানোর চেষ্টা করছে এবং তাদের দাবি অনুযায়ী, যেসব এলাকায় ভারত হামলা চালিয়েছে সেখানে কোনো সন্ত্রাসী ঘাঁটি ছিল না, বরং সেখানে সাধারণ আবাসিক এলাকা বা নিরাপদ সরকারি স্থাপনা ছিল।
এই ঘটনার পরপরই জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং উভয় দেশকে “সর্বোচ্চ সংযম” প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার দপ্তরের তরফ থেকে জানানো হয়, “কাশ্মীর দীর্ঘদিনের একটি স্পর্শকাতর এলাকা। সেখানে সামরিক সংঘর্ষ আরও বড় আকার ধারণ করতে পারে। আমরা উভয় পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির পথে এগোতে বলছি।”
যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও উভয় দেশকে যুদ্ধ পরিহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। ওয়াশিংটনের এক মুখপাত্র বলেন, “উত্তেজনা যেভাবে বাড়ছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমরা এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ সমাধান দেখতে চাই।”
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী কাশ্মীর অঞ্চলে বর্তমানে ব্যাপক সামরিক তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। উভয় পক্ষেই সেনাবাহিনী হাই অ্যালার্টে রয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন এবং বহু পরিবার ইতোমধ্যেই নিরাপদ এলাকায় সরে গেছে।
কাশ্মীরের পুঞ্চ, রাজৌরি, কুপওয়ারা ও বারামুলা অঞ্চলে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ, নীলম ভ্যালি ও কোটলি এলাকায়ও একই ধরনের সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পরেও ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালিয়েছিল, যার জেরে দুই দেশের মধ্যে কয়েকদিন ধরে টানটান সামরিক উত্তেজনা চলেছিল। সেবারও দু’পক্ষ পাল্টাপাল্টি বিমান ভূপাতিতের দাবি করেছিল। তখনও আন্তর্জাতিক মহলের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
তবে এবার পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলেই আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। কারণ দুটি দেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বর্তমানে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। বিশেষ করে ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচন ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এই উত্তেজনাকে আরও স্পর্শকাতর করে তুলছে।
কাশ্মীর সীমান্তে সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উভয় দেশ যদি দ্রুত সংযম না দেখায়, তাহলে এই সংঘাত আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে—এমনটাই মনে করছেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ