
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় টানা মাসের পর মাস ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও রক্তক্ষয়ের পর অবশেষে কার্যকর হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত যুদ্ধবিরতি। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে কার্যকর এই যুদ্ধবিরতির পরই হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি উত্তর গাজায় ফিরে আসতে শুরু করেছেন। দীর্ঘ ১১ মাসের ভয়াবহ সংঘর্ষের পর ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘যুদ্ধের অবসান’ ও বন্দি বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধবিরতির সূচনা হয়। খবর দিয়েছে মিডল ইস্ট আই ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা (গ্রিনউইচ মান সময় সকাল ৯টা) থেকে যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। এর আগে ইসরায়েল প্রথম ধাপের চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সীমান্তরেখা থেকে সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করে। সেনা প্রত্যাহারের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাজার আকাশে ও স্থলভাগে সামরিক অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।
হামাসের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য না এলেও, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তাদের মুখপাত্র ও রাজনৈতিক ব্যুরোর সিনিয়র নেতা খালিল আল-হায়া এক বিবৃতিতে বলেন, “আমরা যুদ্ধের অনির্দিষ্টকালের জন্য অবসানে সম্মত হয়েছি।” তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতারসহ একাধিক মধ্যস্থতাকারী এই চুক্তির নিশ্চয়তা দিয়েছে।
ইসরায়েলি সরকার শুক্রবার সকালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দেয়। এর কয়েক ঘণ্টা আগে হামাসও নিশ্চিত করে যে, তারা একটি ‘সমন্বিত বন্দি বিনিময় ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ চুক্তিতে সম্মত হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচার সংস্থা কান মিশরে স্বাক্ষরিত চুক্তির প্রথম ধাপের একটি ফাঁস হওয়া অনুলিপি প্রকাশ করে। ওই দলিলে উল্লেখ আছে, ইসরায়েল চুক্তি অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধ ‘তাৎক্ষণিকভাবে শেষ হবে’।
দলিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপের বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন। এরপর তিনি মিশরে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন এবং সোমবার ইসরায়েল সফরে যাবেন।
এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কায়রো, তেলআবিব ও ওয়াশিংটনে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “এটি কেবল একটি যুদ্ধবিরতি নয়—বরং একটি স্থায়ী শান্তিচুক্তির সূচনা হতে পারে, যদি উভয় পক্ষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।”
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি উত্তর গাজায় ফিরে যেতে শুরু করেন। স্থানীয় সূত্র ও গণমাধ্যম জানায়, মানুষ দলে দলে খোলা সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করেছে—কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ ছোট ট্রাকে চড়ে, কেউ আবার হাতে বাচ্চা ও মাথায় ঘরবাড়ির ভগ্নাংশ নিয়ে ফিরছে নিজের ভিটেমাটিতে।
গাজার বাসিন্দা মুহাম্মদ আল-নাসের বলেন, “আমরা জানি না ঘরে গিয়ে কী পাব, হয়তো কিছুই নেই, কিন্তু তবুও ফিরে যাচ্ছি—কারণ যুদ্ধ থেমেছে।” অনেক পরিবার দক্ষিণ গাজার শরণার্থী শিবির ও খান ইউনুসের ধ্বংসস্তূপ ছেড়ে উত্তর দিকে ফিরছে, যদিও অধিকাংশ জায়গায় এখনো কোনো অবকাঠামো, বিদ্যুৎ বা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হয়নি।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, চলমান যুদ্ধে প্রায় ১৮ লাখ ফিলিস্তিনি গৃহহীন হয়েছে। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি দক্ষিণ গাজায় আশ্রয় নিয়েছিল। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ, রেড ক্রস এবং অন্যান্য মানবিক সংস্থাগুলো পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
হামাস নেতা খালিল আল-হায়া জানান, “এই চুক্তি শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতি নয়—এটি যুদ্ধের অবসান। আমরা যুদ্ধ বন্ধের বিনিময়ে বন্দি বিনিময়ে রাজি হয়েছি, যাতে ফিলিস্তিনের মানুষ স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারে।”
মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম কাতারও এক বিবৃতিতে জানায়, এই যুদ্ধবিরতি ‘গাজার পুনর্গঠন ও স্থায়ী শান্তি আলোচনার পথ খুলে দেবে।’
হোয়াইট হাউস নিশ্চিত করেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে এই চুক্তির প্রতিটি ধাপে যুক্ত ছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, “এটি মধ্যপ্রাচ্যে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তবে আমরা জানি, প্রকৃত শান্তি তখনই সম্ভব হবে, যখন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাবে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস যুদ্ধবিরতিকে ‘গাজার জন্য আশার আলো’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে মানবিক সহায়তা আবার চালু করা যাবে। হাসপাতালগুলো পুনরায় সচল হবে, এবং শিশুদের আর বোমার শব্দে ঘুম ভাঙবে না।”
তবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরেও শুক্রবার সকাল পর্যন্ত গাজা সিটি ও খান ইউনুসে কয়েকটি ইসরায়েলি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্রের বরাতে জানানো হয়, কয়েকটি এলাকায় ইসরায়েলি ড্রোন থেকে গুলি ছোড়া হয়, যদিও হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। বিশ্লেষকদের মতে, এসব হামলা যুদ্ধবিরতির আগে চলমান অভিযানের অংশ হতে পারে।
গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধ এ পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও বিধ্বংসী সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে ৩৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং কয়েক হাজার ইসরায়েলি সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় সম্পূর্ণ, হাসপাতাল ও স্কুলগুলোর বড় অংশ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এখন প্রশ্ন একটাই—এই যুদ্ধবিরতি কি স্থায়ী শান্তির রূপ নেবে, নাকি এটি কেবল আরেকটি সাময়িক বিরতি? বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি স্থায়ী শান্তির প্রথম ধাপ হতে পারে, তবে ইসরায়েল ও হামাস উভয়ের মধ্যে গভীর অবিশ্বাসের দেয়াল এখনো টিকে আছে।
গাজার মানুষ এখন আশায় বুক বাঁধছে—যেন এই যুদ্ধবিরতি কেবল কাগজে নয়, বাস্তবেও স্থায়ী হয়। উত্তর গাজায় ফিরতে থাকা হাজারো মানুষের চোখে ঝলমল করছে একটুখানি স্বপ্ন—ধ্বংসস্তূপের ভেতরেও হয়তো আবার জীবন ফিরে আসবে।
এক দশকের ধ্বংসের পর গাজায় নেমেছে এক বিরল নীরবতা—যা হয়তো নতুন শুরুর ইঙ্গিত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ